Search Bar

শান্তির খোজে পাবত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য শান্তিচুক্তির একযুগ পেরিয়ে গেছে ৷ এই ঘটনার কাছাকাছি দাঁড়ালে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন পর্বতশীর্ষ থেকে হামাগুঁড়ি দেয় ৷ অপেক্ষার বয়স বেড়ে গেছে, চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের খাতায় পাহাড়বাসীদের অনেক হতাশা অনেকটা শীতের কুয়াশার সকালের পুরনো চাদরের মতোই ৷

খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একদশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত ৷ এখানকার ঢেউ তোলা পাহাড়, ঝর্ণাধারা, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া নদী ও ছড়া, নীল স্বচ্ছ পানির হ্রদ, পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে দূর আকাশের সাদা মেঘ, তার ওপর পাখিদের নীড়ে ফিরে যাওয়া সত্যিই শিল্পীর আকা কল্পনায় ছবির মতো ৷ যদিও বা পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্যপট একান্তই প্রাকৃতিক ৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে আরও তিলোত্তমা করে তুলেছে এখানকার আদিবাসী নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় বর্ণিল সংস্কৃতি ৷ এই পাহাড়ে স্মরণাতীতকাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির সেতুবন্ধন রচনা করে বসবাস করছে পাহাড়ি-বাঙালি মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান ও প্রকৃতি পূজারি প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ৷ এ যেন গোলাপ, শিউলি, জুঁই, চামেলি ফুলের বাহারি রঙের বাগান ৷ শান্তির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারের ভুষিত হয়েছেন ৷ আমাদের মন গর্ভে ভরে উঠেছিল ৷ মাননীয় প্রধমানমন্ত্রী শান্তির জন্য পুরস্কার পেলেও শান্তি নামের সুখ পাখিটার জন্য আজো আমরা পাহাড়ে পাহাড়ে গুমরে কাঁদছি; কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে শান্তি নামের সুখ পাখিটা ৷

এই পাহাড়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই বাঙালি ৷ বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে ৷ এই অযৌক্তিক দাবির স্বপক্ষে জাতীয় পর্যায় থেকেও কোনো কোনো মহল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উস্কে দিচ্ছে ৷ স্থানীয় পাহাড়ি সংগঠনগুলো সবাই এই বাঙালি তাড়ানোর প্রশ্নে একাকার৷ পক্ষান্তরে বাঙালিদের পাল্টা দাবি আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, জম্মভূমি, চৌদ্দ পুরুষের ঠিকানা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাব না ৷ এই পাহাড় আমার অহঙ্কার, এই পাহাড় আমার প্রাণ৷ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের কথা 'শির দেব, তুব আমামা দেব না'৷ নজরুলের এই বাণীর অর্থ জীবন থাকতে মানচিত্রের অপমান মেনে নেব না৷ কারণ বাঙালিরা মনে করে এই পাহাড় থেকে তাদের বিতারিত করার অর্থ হচ্ছে- এই দেশের দশভাগের একভাগ পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্রটি ভিনদেশ বা ভিন্ন কোন ভূ-খন্ড হিসেবে মেনে নেয়া৷ দেশের মানচিত্রে গ্রোথিত পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের যে কোনো নাগরিক বসবাস করতে পারবে সে স্বীকৃতি আমাদের সংবিধানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন৷ যিনি দেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন, যিনি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি তিনিই তো তত্‍কালীন সময়ে পাহাড়িদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, পৃথক মানচিত্র, পৃথক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেয়া হবে না ৷ সদ্য স্বাধীন দেশটি যখন অগোছালো অবস্থায় গুছিয়ে এনে পৃথিবীর মানচিত্রে শির উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য মরিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ঠিক তখন সন্তু লারমার বড় ভাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তত্‍কালীন পার্বত্য এমপি ও তার একটি দল স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেন৷ অতি ক্ষোভ দুঃখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই দেশ অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে৷ এই দেশে নতুন ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবে না ৷ তোমরা বাঙালি হয়ে যাও৷ এই কথায় উপজাতিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে৷ ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে এমএন লারমা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গঠন করেন৷ এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে৷ যার নাম দেয়া হয় শান্তি বাহিনী ৷ এই শান্তি বাহিনী চীন থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে অস্ত্র পেত৷ তাদের মার্কবাদ, লেলিনবাদ দীক্ষা দেয়া হয়৷ রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক আদর্শ হিসেবে পাহাড়ি সাংস্কৃতিক আদর্শকে দীক্ষা দেয়া হয়৷ শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ওপারে ভারতের অভ্যন্তরে ২৫টি ক্যাম্প গড়ে তোলে ৷ সেখানে সশস্ত্র গেরিলা ট্রেনিং দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিএসএফ৷ ১৯৭৫ সালে অভু্যত্থানের পর জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় তখন চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তারপর থেকে চীন শান্তিবাহিনীকে মদদ দেয়া বন্ধ করে ৷ এরপর ভারত সরাসরি তাদের মদদ দেয় ৷ ১৯৭৬ সালে সন্তু লারমা সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তত্‍কালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় কথা হলে সন্তু লারমা আর বিপথগামীদের নিয়ে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কাজ করবেন বলে ওয়াদা দেন ৷ এ ওয়াদার পর রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউস থেকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয় ৷ মুক্ত সন্তু লারমা ফিরে গিয়ে পূর্ণোদ্যমে বিদ্রোহ চালাতে থাকে৷ নতুন করে মদদ আসে ভারত থেকে৷ সন্তু লারমার বিশ্বাস ঘাতকের কারণে জিয়াউর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধান মোতাবেক এই অঞ্চলকে সকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আওতায় আনতে হবে মনে করেন৷ ১৯৮৯-৮২ সাল পর্যন্ত শুরু করেন দেশের বিভিন্ন নদী ভাঙা ভাসমান বাঙালিদের বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া ৷ যা যে কোনো দেশের জাতিগত বিদ্রোহ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর বলে বিবেচিত৷ সে সময়ে শান্তিবাহিনীর আরেকটি গ্রম্নপের আবির্ভাব হয় ৷ এর নাম দেয়া হয় প্রীতিগ্রুপ ৷ প্রীতি গ্রুপের হাতে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর এম এন লারমা খুন হন ৷ শান্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা৷

১৯৮৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলের ৩৪(১) ধারা সংশোধন করে সেখানে বসতি স্থাপন এর অনুমতি দেয়া হয়৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণাতীতকাল ধরে বসবাসরত আদিবাসী বাঙালিরা এই পরিবর্তন মেনে নিলেও চাকমাসহ কয়েকটি উপজাতি তা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি৷ শুরু হয় পুনর্বাসিত বাঙালিদের ওপর গণহত্যা৷ খাগড়াছড়ি সদরের কুমিল্লা টিলা, হরিণাথপাড়া, মাটিরাঙ্গা, তবলছড়ি, তাইন্দং, পানছড়ি, ছনটিলা, ফাতেমা নগর, লোগাং, দীঘিনালা, রশিক নগর, মেরুং, মহালছড়ি, মাইচ্ছড়ি, রাঙ্গামটির বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর, লংগদু, কাউখালীতে বাঙালি বসতি হাট-বাজার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনী৷ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী অসংখ্য গণহত্যার নায়ক৷ বাঙালি সংগঠনগুলোর দাবি শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা প্রায় ৩০ হাজার বাঙালি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি, ভিন্ন মত পোষণকারী চাকমা, মারমা ত্রিপুরা, সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, ভিডিপিকে হত্যা করেছে৷ শান্তিবাহিনীর হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের হাত থেকে রেহাই পায়নি পাহাড়ি-বাঙালি কেউই৷ উপজাতি জুম চাষিকে পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়েছে৷ আর শান্তিবাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিল, বাঙালি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, গাছ-বাঁশ ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীরা৷ সন্ত্রাসীদের অব্যাহত মুক্তিপণ আদায় ও চাঁদাবাজির কারণে পার্বত্য অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসে৷ এ ছাড়াও উন্নয়নমূলক কাজে বাধা প্রদান, নাশকতামূলক তত্‍পরতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থির করে তোলা হয়৷ অশান্ত হয়ে পড়ে সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রাম৷ ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমাসীন হওয়ার পর চারটি আইন প্রণয়ন করেন৷ এই আইন প্রণয়নে তত্‍কালীন সব দলের সম্মতি ছিল৷ প্রথমটিতে ১৯০০ সালের হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল বা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি রহিত করা হয় ৷ আর তিনটি আইনের মাধ্যমে তিনটি স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করা হয়৷ খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় পৃথক তিনজন উপজাতি চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়৷ এই আইনের মাধ্যমে নতুন বসতি স্থাপন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়৷ পরিষদের সম্মতি ছাড়া কোনো নতুন লিজ দেয়া হবে না বলে উল্লেখ করা হয়৷ ১৯৮৪ সালে নতুন আইন প্রয়োগের আগে রাঙ্গামাটির ভূষণছড়ায় এক বাঙালিকে একটি জায়গা লিজ দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শান্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়৷ বাঙালিরাও পাল্টা আক্রমণ চালালে চারশতাধিক মানুষ নিহত হয়৷ এতে বাঙালিদের চেয়ে পাহাড়িরা বেশি মারা যায়৷ একের পর এক পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চলতে থাকলে বাঙালিরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে৷ বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি-পাহাড়ি দাঙ্গা শুরু হয়৷ এরই সুযোগে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশে শান্তিবাহিনী দলে দলে উপজাতিদের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য করে৷ সীমান্ত অতিক্রম করে ১২ হাজার ২২২টি উপজাতি পরিবার ত্রিপুরার ৬টি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়৷ এই শরণার্থীদের দেখিয়ে শান্তিবাহিনী আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ পেয়ে যায়৷ ১৯৯২ সালে শান্তিবাহিনী একতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেয়৷ এই যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দিয়ে শান্তিবাহিনীকে আরো গুছিয়ে নেয়া হয়৷ কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশনের মুখে শান্তিবাহিনী অনেকটাই দুর্বল হয়ে এসেছিল৷ ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে কিছু শরণার্থী সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বদেশে ফিরে আসে৷ পরে শরণার্থীরা স্বদেশে আসতে বিভিন্ন শর্তারোপ করে৷ এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, বাঙালিদের প্রত্যাহারের দাবিও ছিল৷ মূলত জনসংহতি সমিতির দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, বাঙালিদের প্রত্যহার, সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার, প্রচলিত বিধি বিধান বহাল রাখা ও জুম্মদের জায়গা ফিরে দেয়ার দাবিরই নামান্তর৷ শরণার্থীরা এসব দাবি সব সময়েই করে আসছিল৷ এ ছাড়াও যুদ্ধ বিরতির সুযোগে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহড়ি গণপরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন নামক আঞ্চলিক ছাত্র, যুব ও নারী সংগঠনগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে বাঙালি ও সেনাবাহিনী খেদাও আন্দোলন গড়ে তোলে৷ এই সংগঠনগুলো শান্তিবাহিনী তথা পার্বত্য জনসংহতি সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল৷ ১৯৮৮ সালে শান্তিবাহিনী তাদের পাঁচ দফা দাবি নামায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিল৷ তবে সত্তরের দশকে মিজোরাম, অরুণাচল ও মনিপুর পর্যন্ত জুমল্যান্ড গঠনের সীমানা ছিল৷ পরে উপজাতিরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দাবি তুলছে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড করার৷

সেই জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বাদ ধীরে ধীরে ভেস্তে যেতে বসে আমাদের সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী কাউন্টার ইমার্জেন্সির মুখে ৷ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমাধানের সিদ্ধান্ত নেয়৷ শুধু হয় শান্তির সন্ধানে শান্তি আলোচনা৷ আলোচনা ফলপ্রসু হলে অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ শান্তিচুক্তির পর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রম্নয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা আনুষ্ঠাকিভাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে ৷ এই অনুষ্ঠানে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের জন্য ইউপিডিএফ নামে একটি নতুন বাহিনীর আবির্ভাব ঘটে৷ এই অস্ত্র সমর্থন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিদেশি কূটনৈতিক, সাংবাদিক, দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন৷ শান্তির অন্বেষায় যেখানে কেটে গেল দুইটি দশক৷ যেদিন সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতির অবসান ঘটবে পাহাড়ে এমন আশায় বুক বাধে পাহাড়ি-বাঙালি ১৫ লাখ মানুষ ঠিক তখনই আবার সন্ত্রাসের সূত্রপাট ঘটে ৷ ইউপিডিএফ নামক সংগঠনটি এবার পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শান্তিবাহিনীর প্রতিমূর্তি রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয় ৷ শান্তিবাহিনীর শূন্যস্থান পূরণ করে ইউপিডিএফ ৷ তাদের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল ইউম্যান্স ফেডারেশন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে৷ আর ইউপিডিএফর সশস্ত্র গ্রম্নপটি পাহাড়ি জঙ্গলে সশস্ত্র তত্‍পরতা অব্যাহত রেখেছে ৷ এখন তাদেরকে পার্বত্যবাসী চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছে ৷ শান্তিবাহিনীর মতোই হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, নাশকতামূলক তত্‍পরতা চলছে ৷ এই ইউপিডিএফের দাবিও শান্তিবাহিনীর দাবির প্রতিচ্ছবি পাওয়া গেছে ৷ ইউপিডিএফ বাঙালিদের প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার ৷ অন্যদিকে আধিপত্য বিস্তারের খেলায় সন্তু লারমা নিয়ন্ত্রণাধীন জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে উভয় পক্ষের প্রায় ৫০০ জন লোক মারা গেছে ৷ সম্প্রতি সন্তু লারমার নেতৃত্ব ছেড়ে শত শত জেএসএস নেতাকর্মী সশস্ত্র একটি অংশ ইউপিডিএফের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বপক্ষ ত্যাগ করেছে৷ বর্তমান সন্তু লারমাও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি ও সেনাবাহিনী খেদাও দাবির পক্ষে৷ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সংগঠনগুলোর বাঙালি ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে কোনো বিভেদ নেই৷ যত বিভেদ আধিপত্য বিস্তার ও মোটা অঙ্কের চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে৷
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম কী বাংলাদেশ নয়? যদি বাংলাদেশ হয়ে থাকে তাহলে কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা সরকার প্রদত্ত বন্দোবস্তপ্রাপ্ত বৈধ ভূমিতে বসবাস করতে পারবে না? ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকেই তো বাঙালিার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে৷ সংবিধানে রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষ অসামপ্রদায়িক দেশে সব সমপ্রদায় সমান অধিকার ভোগ করবে৷ গণতান্ত্রিক দেশে সবাই মিলেমিশে বসবাস করবে এটাই নিয়ম৷ ১৯৫৬ সালে হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েলের ৫১ ধারা রহিত করা হয়৷ ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান আমলে ঢাকা হাইকোর্টের রায় অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত একটি সাধারণ অঞ্চল হিসেবে কার্যকর করা হয়৷ এই অঞ্চলকে কোনো বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়নি৷ ঐ রায়ে সমগ্র পাকিস্তানের সর্বত্র সকল নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয়৷ বস্তুত তখন থেকেই বাঙালিার পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্বের তুলনায় বেশি বসতি গড়ে তুলে৷

উপজাতি নেতাদের দাবি, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজপুত্র বা আদিবাসী৷ কিন্তু বাঙালিরা বহিরাগত৷ ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে মাত্র ২-৩শ বছর পূর্বে উপজাতিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত, মিয়ানমার ও চীন থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ১৫৫০ সালেও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসবাস ছিল৷ বাঙালিরা তত্‍কালীন সময়ে পাহাড়ি এলাকা সাশন করেছিল৷
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় কতিপয় উপজাতি হেডম্যান ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে থাকতে চাইলে উপজাতিদের নেতা কামিনী দেওয়ান পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার পক্ষে মত দেন৷ কারণ তিনি মনে করতেন চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলন্বী বিধায় হিন্দুদের প্রতাপের কাছে নিরাপদ নয়৷ আর ক্ষুদ্র উপজাতিদের ছোট দেশের সঙ্গে থাকাই নিরাপদ৷ উপজাতি চাকমাদের বিশাল একটি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার জন্যই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে৷ রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেল চিফ বা চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (বর্তমান চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশিষ রায়ের পিতা) স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পরে পাকিস্তানে চলে যান৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যারা ইতিহাসে যারা বিশ্বাসঘাতক, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে আলাদা করার স্বপ্নে বিভোর, যারা জুম্মল্যান্ড গঠনের আন্দোলনে সংগ্রামমুখর তাদের হাতেই একের পর এক ছেড়ে দেয়া হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বময় ক্ষমতা৷ তারা অস্ত্র ধরে পেয়েছে পুরস্কার, আর যারা অস্ত্রের বিরুদ্ধে তারা পেয়েছে তিরস্কার৷ বাঙালিরা আজো তিরস্কারের স্বীকার হচ্ছে৷ এখনো থামেনি উপজাতিদের বাঙালি খেদাও আন্দোলন৷ পাশাপাশি সেনাবাহিনী খেদাও আন্দোলনও জোরদার হচ্ছে৷ কিন্তু কেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিার চলে যাবে? বাঙালি কী রোহিঙ্গাদের মতো ভিনদেশি নাগরিক? রোহিঙ্গারা পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে ভোটার হয়ে গেছে৷ যারা এদেশের বাড়তি চাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে৷ সেই রোহিঙ্গাদের প্রায় ২ লাখ নাগরিক আজ ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছে৷ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকাভুক্ত করতে পারলে নিজ দেশের নাগরিকদের কেন নিজ দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেবে? কতিপয় উপজাতি নেতার কাছে কেন মাথা নত করবে? আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা শহীদ জিয়ার মতো নেতারা জীবিত থাকলে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়ার দাবিদারদের কখনই ক্ষমা করতেন না৷ তাদের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অপরূপ সৌন্দর্যের অাঁধার পাহাড়টি ভালো না লাগলে যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যেতে পারে এর স্বাধীনতা তাদের প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে৷ যেহেতু তারা প্রকৃতির সন্তান৷ আজ তারা চীনের তিব্বত পাহাড়ে, কাল তারা ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড়ে, পরশু তারা মিয়ানমারের পাহাড়ে এই তো তাদের জীবন বৈচিত্র্য৷ তাদের সেই জুমচাষের জীবন বৈচিত্র্যে আমাদের কোনো আপত্তি নেই৷ তারা আমাদের দেশে আমাদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করবে এটাও তাদের সাংবিধানিক অধিকার৷ আর আমরা এখানে আছি, এখানেই থাকব এটাও আমাদের জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার৷ কেউ কাউকে ছেড়ে নয়, কাউকে দূরে ঢেলে নয়, সকলে মিলেমিশে এই সম্ভাবনাময় পাহাড়ি অঞ্চলকে আমরা কী পারি না ভেদাভেদ ভূলে গিয়ে নতুনভাবে সাজাতে৷ এখানকার তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ, মত্‍স্য সম্পদ, ভূ-সম্পদকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে৷ আমরাও পারি৷ এ জন্য প্রয়োজন কাউকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, কাছে টেনে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ রেখে পাহাড়ি-বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলের সম্মিলিত একটি সুন্দর ফুল বাগান৷ যে বাগানে থাকবে গোলাপ, শিউলি, জুঁই, চামেলি আরও কত কিছু ...৷ আমরা যে শান্তির জন্য শান্তিচুক্তি করেছি সে চুক্তির কোথায় লেখা নেই বাঙালিদের সরিয়ে নিতে হবে৷ তাহলে কেন এখনো বাঙালি বিতারিত করার ঢামাঢোল বাজানো হচ্ছে৷ একদিকে ভারত অন্যদিকে মিয়ানমার আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে রেখেছে৷ সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সেনাবাহিনীর উপস্থিতি প্রয়োজন৷ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক আমাদের গর্ব সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কার জন্য সমস্যা হচ্ছে সাধারণ উপজাতি না সাধারণ বাঙালির৷ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যই তো সেনাবাহিনী৷ সেনাবাহিনী কার জন্য সমস্যা সন্ত্রাসীর জন্য নাকি ভালো মানুষের জন্য সমস্যা৷ সেনাবাহিনী বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সম্পূর্ণভাবে চলে গেলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কী জুম্মল্যান্ডের নতুন পতাকা তুলে দেয়া হবে, নাকি সেই পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো হবে, নাকি ভারতীয় পতাকা! তাই বলি শান্তি কতদূর৷ শান্তির শ্বেত পায়রা কী পাহাড়ে ফিরে আসবে৷ নাকী শান্তি নামের সুখ পাখির অপেক্ষায় কেটে যাবে আরো একটি শতাব্দী৷ আরও অনেকগুলো বসন্ত৷ আরও অনেকগুলো প্রজন্ম৷

Post a Comment

0 Comments