Search Bar

উপন্যাস

শেষ রাতের সবপ্ন
এক


সেই অনেকদিন ধরে লেখার প্রবল ইচ্ছা । কিন্ত বাউন্ডেলের সুযোগ না হলে কি করে লিখবে ? আজ কাল করতে করতে জীবনের কত বসন্ত কাটিয়ে দিয়েছি তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চল্লিশ যে পার হয়েছে সেটা বুঝতে পারি । অবশ্যই যে টুকু সময় গেছে তা পরিশ্রমের ক্লান্তির অবসানে । মনে মনে ভীষন ভয় পাচ্ছি, কোথায় কি আবার হয়ে না যায় । ভাবছি লেখাটা ভালো হবে তো, কেহ পড়বে তো ? কেমন করে শুরু করে শেষ করব মাথায় সেই প্যাচটা ঘুরপাক খাচ্ছে । আমার এক বন্ধু, নাম নজরুল । সাহিত্যের উপর তার অনেকটা দখল ছিল তাই আমি তাকে আদর করে সাহিত্যিক বলে সম্বোধন করতাম । সে মাঝে মাঝে বলত তোদের এই না পারা কথাটা শুনার জন্য আমার জন্ম হয় নাই । তারই কথার রেশ ধরে আমিও মনে মনে ভাবতাম হেরে যাবার জন্য তো আমারও জন্ম হয় নাই। সেই মনোবল প্রকট থাকায় কলমটা চেপে ধরেছি । যদিও আধো আধো হাত কাপছে তবুও এতটুকু বিশ্বাস আছে আধার রাতের শেষ তারার সাথে দেখা হতে পারে । গুন টানার গল্পটা একটা কোর্স করার সময় পড়ার ফাঁকে এক বন্ধু করেছিল। গল্পটা সেই বন্ধুর নিজের জীবনে ঘটেছিল । গল্পটা এমনই, সে একসময় (ছাত্রজীবনে) বাজারে গিয়েছিল । বাজারটা তাদের বাড়ী থেকে ৯/১০ কিঃমিঃ দুরে । আষাঢ় মাস । আকাশে কালো মেঘ জমেছে । বিকালের দিকে প্রচুর বৃষ্টিও হয়েছে । প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তা । কাচা রাস্তা হওয়ায় কাঁদাও হয়েছে প্রচুর । এক কথায় হেটে আসার অযোগ্য তার ভাষায় । সে বাজারে অনেকক্ষন ঘুরল কোন পরিচিত নৌকা পাওয়া যায় কিনা । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে । তার উপর অন্ধকার রাত । মাঝে মাঝে কান ফাটানো বজ্রের আওয়াজ । ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এমন একটা পরিস্থিিিততে সে নৌকা না পেয়ে অগ্যতা হেটে রওনা করল । বেশ কিছুদুর আসার পর সে দেখল তার পাশের গ্রামের ৭/৮ জন লোক একটি নৌকা নিয়ে বাজার থেকে ফিরছে । তার কাছে বাজারের কিছু সওদাও রয়েছে । অবশ্য মাঝে সে নাকি দুবার আছাড় ও খেয়েছে । যাইহোক নৌকা দেখে তার মনে সাহস জাগল । এই বূঝি কষ্টের পালা শেষ হলো । অন্ধকার রাতে তাদেরকে জিঞ্চাসা করল ভাই আপনারা কোথায় যাবেন ? তারা তার গ্রামের পাশের গ্রামের নাম বলল । তখন সে বিনয়ের সুবে বলল ভাই আমি তো ঐ গ্রামে যাবো । পিচ্ছিল রাস্তায় খুব কষ্ট হচ্ছে যদি দয়া করে আমাকে একটু নিয়ে যান । আমি ছাত্র মানুষ। আমার মাথায় কিছু সওদাও আছে । তাছাড়া অন্ধকারে ভয় ও পাচ্ছি । এত কথা বলার পর প্রতিউত্তরে তারা বলল ভাই ছাত্র, তোমার কথা সব শুনেছি কিন্ত আমাদের নৌকায় তো জায়গা নেই । তখন তার গ্রামে পৌছাতে আর চার পাচ কিঃমিঃ রয়ে গেছে । নৌকার সাথে হাটতে হাটতে অনেক কথা হলো । কিন্ত তারা তাকে নিতে রাজি হলো না । তখন সে বলল, ভাই আপনাদের নৌকার গুনের রশিটা আমাকে দেন আমি না হয় রশি টেনে যাবো । নৌকা থেকে একজন জিঞ্চেস করল তাতে তোমার লাভ কি ? সে বলল খুব ভয় পাচ্ছি তাই যাতে আপনাদের সাথে যেতে পারি তার জন্য গুন টেনে যেতে চাই । তারা হেসে বলল, এতো আজব কথা শুনছি । আমার বন্ধুটি বলল, তাদেরকে এতকিছু বলার পরও তারা তাকে নিতে অনিহা প্রকাশ করল । বিন্দুমাত্র তাদের ভিতর দয়ার উদ্রেক হলো না । সে তাদের সাথে হেটেও পারছে না । তাদের কথা বার্তায় মনে হলো তারা তাকে নেবে না । তাই এক পর্যায়ে সে প্রস্তাব করল ভাই আমাকে নৌকায় নিতে হবে না বরং গুন টেনে যাবো এবং আমি অতিবিক্ত আরও দশটি টাকা আপনাদের দেব । নৌকা থেকে একজন বলল দশ টাকায় হবে না পনের টাকা দিতে হবে । আর এভাবেই সে রাতে সে পনের টাকা দিয়ে কিছু পথ গুন টেনে এবং কিছু পথ নৌকায় চড়ে বাড়ী পৌছে ছিল । গল্পটা বেশ মুখরোচক, শুনে খুব হেসে ছিলাম । ঘটনাটি হাস্যরস হলেও সত্যি বেদনাদায়ক । মানবতার এক চরম অবমাননা । মাত্র পনের টাকার বিনিময়ে তার নৌকায় বসার জায়গা হলো । গল্পটি আমার মনে চরমভাবে রেখাপাত করে । তার গল্পটা এখানে শেষ হলেও তারই রেশ ধরে এত বছর পর আমার আর এক ঘনিষ্ট বন্ধুর ভাংগা গড়া জীবনের গল্পটা শেষ করতে হয়ত তার মতো গুন টেনে শেষ করতে হবে । আর যারা পড়বে তাদের বারো বেজে যাবে । বন্ধুটির নাম জ্ঞজীবনঞ্চ । অবশ্য এটা তার ছদ্ম নাম । তার কৈশরের কথা এতকিছু এখন মনে নেই । যতটুকু বলেছে তার উপর ভিত্তি করে আমার মনে ভাঙা ভাঙা স্মরন হলেও গুছিয়ে লেখার মত ছ্যাছড়া আমি নই । ছোট বেলা থেকে জ্ঞজীবনঞ্চ ছিল একটু ডান পিঠে যার কারনে পোড় খেতে খেতে কিছু ডায়ালগ এখনও তার মন মন্দিরে উদ্ভাসিত হয় । যা তাকে বার বার তাড়া করে ফেরে । আর তারই উপর ভিত্তি করে আমার এই লেখার প্রয়াস । এখানে তাকে খুব একটা ডানপিঠে বলা যাবে না। কেননা দিনের আলোতে তার সাহস থাকলেও রাতের বেলায় সে ছিল একেবারে ভিজে বিড়াল । ভয়ে মায়ের হাত ধরে সে বারান্দায় বসে প্রসাব করতো । বারান্দা যে কত বার সে নষ্ট করেছে তার ইয়ত্তা নেই । এই ছিল জীবনের ডানপিঠের বাহাদুরী। তাকে ডানপিঠে ঠিক না বলে ইচড়ে পাকা বলা যেতে পারে । কেননা সে সব সময় বড়দের চেয়ে দু লাইন বেশী বুঝত । আর এ জন্যই অনেকের কাছে সে ছিল অপ্রিয় । তার মত ছেলের ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার । তার মায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলা দেখে পড়া ও নাম স্বাক্ষর করার যোগ্যতা টুকু অর্জন করেছিল । সে দুঃখ করে সব সময় বলত তার মায়ের এই ঊণ সারা জীবনের সেবা দিয়ে পরিশোধ করতে পারবে না ।



দুই

স্কুল ফাকি দেয়া ছিল তার জ্ঞজীবনঞ্চ এর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । অবশ্যই এর কারণও ছিল । পাড়ার মধ্যে সে আর তার ফুফু ছাড়া কেহ স্কুলে যেত না । বাড়ীর সামনে প্রাইমারী স্কুল । সে ক্লাশ থ্রি তে উঠল । এবার তার মা তাকে প্রাইমারীতে না পাঠিয়ে পাঠশালায় দিলেন । তাও আবার সাত্তার মাষ্টারের পাঠশালা । যার নাম শুনলো এখনো তার পেটের ব্যাথ মোচড় দিয়ে উঠে । মাষ্টার সাহেব সর্ম্পকে জ্ঞজীবনঞ্চ এর ভাই হয়, তাই সাহস নিয়ে ভর্তি হয়েছিল । প্রথম দিন ক্লাশে মাষ্টার মশাই তাকে বলে দিল, সে ক্লাশ থ্রির যোগ্যতা রাখে না । তার পাঠশালায় পড়তে হলে ক্লাশ টু তে পড়তে হবে এবং হাতের লেখা ভাল করতে হবে । জীবন বেশ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল । সাথীরা সবাই বড় ক্লাশে পড়বে আর তাকে আবার ক্লাশ টু তে , এ যেন সে মানতে পারছে না । যাইহোক সন্ধ্যায় মাষ্টার মশাই তার মাকে কি যেন বূঝিয়ে গেল, আর অমনি তার পদাবনতি হলো । পরের দিন জ্ঞজীবনঞ্চ ক্লাশ টু এর ছাত্র । মনটা তার ছোট হয়ে গেল । তার উপর পড়া না হলে যেভাবে মারে তা দেখে তার কলিজা পর্যন্ত কাপতো । মানুষ মানুষের এভাবে মারে ? মার দেখে তার ঐ পাঠশালা ভাল লাগল না । শুরু হলো তার স্কুল ফাঁকির অভিনব কৌশল । প্রতিদিন স্কুলে যেত না, মাঝে মাঝে বাড়ী থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও পথিমধ্যে কারোর বেড়ের ভিতর বা বাগানের ঝোপ ঝাড়ে বসে স্কুল টাইম পার করে তারপর বাড়ী ফিরত । প্রায় সময় তাকে ধরে নেয়ার জন্য বাড়ীতে ছাত্র পাঠিয়ে দিত । সেও কম যাবার নয় । ছাত্ররা ধরতে আসলে সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকত । একদিন ঘর খুড়ে, দরজা ভেংগে তাকে বের করতে হয়েছিল । অন্য একদিনের ঘটনায় আজও তাকে কঠিন ভাবে আলোড়িত করে, সেদিন সে স্কুলে যায়নি অগত্যা তাকে ধরার জন্য ছয়জন ছাত্র আসল । ওদের সাথে সে স্কুলে যাচ্ছে হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি আসল যদি সে স্কুলে যায় তাহলে আজ তার পিঠের চামড়া গরম করবে । তাই সে বইয়ের ব্যাগটা একজনকে ধরিয়ে দিয়ে নদীতে লাফ দেয় । সাথে সাথে তার ক্লাশমেট মোস্তফাও লাফ দিয়ে মাঝ নদীতে গিয়ে ধরে ফেলল । অগত্যা উঠে আসতে হলো এবং ঐ ভেজা কাপড় পরে তাকে পাঠশালায় যেতে হলো । সেদিন তাকে আড়ার সাথে গামছা দিয়ে হাত বেধে ঝুলিয়ে মেরেছিল, সে দুঃখ করে আমাকে বলেছিল হায়রে আমার সাত্তার ভাই, তোমার কথা আজীবন মনে থাকবে । সে মারার কথা তার মনে হলে পিঠে হাত দিয়ে আজও সে আতংকিত হয় । স্কুল ফাকি দেয়ার তার আরও একটা কারণ ছিল । বাড়ীর পাশে প্রাইমারী রেখে অনেক দুরে তিন বেলা পাঠশালায় যাওয়া আসা তার পছন্দ ছিল না । প্রতিনিয়ত মারপিট চলত তার উপর । তিন বছর ঐ পাঠশালায় তার স্কুল ফাকি আর মারপিটের মধ্যে কেটেছে । পাড়া প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজনের কাছে মান সম্মান বলে তার কিছু ছিল না । এদিকে পাড়ার কিছু লোক এসে তার বিরুদ্ধে নালিশ করে তার দাদার কান ভারি করে দিত । তার দাদা ছিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান । চাটুকারের অভাব ছিল না । তার দাদাকে কেহ প্রশংসা করলে তাকে না খাওয়ায়ে ছাড়তো না । জীবন কোন অপরাধ না করলেও তার বিরুদ্ধে প্রতিদিন দুঞ্চ তিনটি অভিযোগ থাকতো । সে তার দাদাকে অনেক বার বুঝাবার চেষ্টা করেছে যে, যে সমস্ত লোক এসে তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয় তা ঠিক নয় কিন্ত তার পয়েন্ট জিরো থাকায় বাড়ীতে কারোর কাছে তার কোন কথা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না । দাদার বুকুনি, বাবার হাতের মার আর মাষ্টার সাহেবের বেতের লাঠির মার ছিল তার নিত্য দিনের পাওনা। একদিন রাত ৯ টা বেজে গেছে জ্ঞজীবনঞ্চ কে খুজে পায় না তার মা । অনেক খোজাখুজির পর পেল পাশের শরিকের বৈঠকঘরের দরজার কোণে লুকানো অবস্থায় । স্কুলে যায়নি, বাবার হাতের মার খাবার ভয়ে লুকিয়ে আছে । তার মা বাড়ীতে নেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করলো কিন্ত সে জানালা ধরে দাড়িয়ে রইল, তার মা তাকে জানালা থেকে হাত ছাড়াতে না পেরে, এক পর্যায়ে ল্যাম্প দিয়ে মাথার চুল পুডিয়ে দিল । সবার কাছে ছিল এক অবহেলার পাত্র । অপরাধ না করেও বুকুনি শুনতে হতো বলে সে ঐ বয়সে অনেক বার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছে কিন্ত পরক্ষনেই আবার নিজের মধ্যে সাহস নিয়ে বলত মরার জন্য তার জন্ম হয়নি । তাকে বেঁচে প্রমান করতে হবে । যারা বলত লেখাপড়া হবে না তাদেরকে দুচোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায় সে যে, জ্ঞজীবনঞ্চ মানুষের মত মানুষ হয়েছে । পবিত্র কোরআন শরীফের অমিয় মহান বানী তাকে প্রতিমুর্হুতে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে - জ্ঞজ্ঞপ্রকৃত সাহসী তারা, যারা সাহস না হারিয়ে বিপদ ও দুঃখের মধ্যেও যুদ্ধ ক্ষেত্রে দৃঢ়তা অবলম্বন করে এবং ধৈর্য্য ধারণ করেঞ্চঞ্চ ।





তিন

সাত্তার মাষ্টারের পাঠশালায় ক্লাশ ফোর শেষ করে জ্ঞজীবনঞ্চ আবার ক্লাশ ফাইভে প্রাইমারীতে ভর্তি হল । এখন আর স্কুল ফাকি নয় । বাড়ীর সামনে স্কুল । বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি । হারানো সম্মান কিছুটা ফিরে পাবার প্রচেষ্টা । ফাইভ শেষ করতেই তার দাদা আবার তাকে অনেক দুরে কয়রা সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিল । দাদা পরিবারের একমাত্র ক্ষমতাধারী কর্তা । তার উপর দিয়ে কথা বলার কেউ সাহস রাখে না । অগত্যা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাদাকে খুশী করার জন্য সে ঐ মাদ্রাসায় ভর্তি হলো । বাড়ী হতে ৮/১০ কিঃমি দুরে সেই মাদ্রাসা। বাড়ী থেকে সেই মাদ্রাসায় যেতে সময় লাগে ২ ঘন্টা । এত অল্প বয়সে এত পথ হেটে যাওয়া কম ধৈর্য্যের ব্যাপার ? ঐ মাদ্রাসায় প্রথম ক্লাশ ফাইভ থেকে শুরু । তাকে আবার পুরাতন ক্লাশে ভর্তি হতে হলো। বার বার তার মন ভেংগে যেতে লাগল । সাথের বন্ধুরা নতুনের গন্ধে, মনের উদ্দামে উপরে উঠে যেতে লাগল । আর সে দিন দিন পিছে পড়ে যাচ্ছে । সে দুঃখ করে বন্ধুদের বলত তোরা তাকে নিয়ে ভাবিস না, সে আদু ভাই এর ছোট ভাই হয়ে থাকবে। পাড়ার অনেকের সাথে তার আকবর দাদা তাকে মনে কষ্ট দিয়ে বলত উনি আমাদের নবযুগের আদু ভাই । যাইহোক পথের দুরত্বে সে আবার পুরাতন ব্যবসায় ফিরে গেল অথার্ৎ আবার তার মাদ্রাসা ফাকি দেয়া শুরু হলো । কোনমতে ঐ মাদ্রাসায় এক বছর পার করে আবার মাদ্রাসা বদলী করলো । এবার ভর্তি হলো বাড়ী থেকে ৩/৪ কিঃমিঃ দুরে কালনা আমিনিয়া মাদ্রাসায় । ভর্তির দ্বিতীয় দিনে একজন শিক্ষক নাম আতাউল গনি তাকে এসে বলেছিল তুমি কি গাজী সাহেবের নাতি ? সে ভয়ে ভয়ে উত্তর দিয়েছিল জি হ্যাঁ । তার পাঞ্জাবীর উপরের বোতাম খোলা ছিল । তিনি তার পাঞ্জাবীর বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলেছিল ঢিলা ঢালা হওয়া যাবে না, টাইট হতে হবে, বুঝেছ ? জ্ঞজীবনঞ্চ এর ভাষ্যমতে ঐ শিক্ষক আরো দু লাইন বাড়িয়ে বলেছিল এখন থেকে আর স্কুল ফাকি দেয়া যাবে না । তার দাদার সাথে উনাার কথা হয়েছে বলে জানালেন । জ্ঞজীবনঞ্চ এখন মনে মনে ভাবছে, সেরেছে, সে যে স্কুল ফাকি চোর এটাও জেনে গেছে । সে মনে মনে ভাবে এখানেও তার সম্মান থাকবে না । অবশ্যই গনি সাহেব নাকি তাকে সাহস দিয়ে বলেছিল, তার কোন সমস্যা হলে যেন সে তাকে জানায় । এরকম আশ্বাসে ঐ শিক্ষকের প্রতি তার আগ্রহটা একটু বেড়ে যায় । দিন দিন তার সাথে ঐ শিক্ষকের আন্তরিকতা, ভালবাসা গভীর হতে থাকে । শিক্ষকও তার ভালবাসা অনুভব করল । শিক্ষকের ব্যবহারে সে বুঝতে পারে তিনি তাকে খুব সেনহ করেন ।



চার

যখন সে ক্লাশ নাইনে উঠে তখন তাদের সংসারের অবস্থা খুবই বেহাল । একান্নবর্তী পরিবার, অনেক খাওয়ার মুখ কিন্ত রোজগারের কোন লোক ছিল না । জমির উপর তার দাদাকে সংসারের সকল ব্যয়ভার বহন করতে হতো । তাই তার দাদা একদিন তাকে ডেকে বলে দিল তাকে আর পড়ার খরচ দিতে পারবে না। তার দাদা সম্মানীয় লোক এবং এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল । বাড়ীতে সব সময় লোকজনের গম গম আওয়াজ । কাজের লোক আর চাটুকারদের পদভারে মুখরিত থাকত সকল সময় । গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ এটা সেকালের গল্প নয় । এ তার পরিবারে তার জীবনে দেখা বাস্তব সত্য । চাকুরী করে তাকে খেতে হবে এটা সে বয়সে সে কোনদিন চিন্তা করেনি । তার দাদার ভালো মানুষের এবং সততার পরিচয়ে একান্ত কাছের মানুষেরা তার দাদাকে ঠকাতে লাগল । বাড়ীর কারোর কথা তার দাদা রাখতেন না । বাইরের লোকের বুদ্ধি এবং পরামর্শ সব সময় গ্রহন করতেন । তার বাবা কিছু করতেন না বলে তাদের কথার কোন মুল্য ছিল না তার দাদার কাছে । তার দাদা ছিল অত্যন্ত, সাহসী ও জেদী মানুষ । তার এসএসসি পরীক্ষার আগেই সামান্য কিছু বাদে তাদের সকল জায়গা জমি তার দাদা বেহাত করে ফেলে । সংসারে নিরব দুর্ভিক্ষ । লজ্জায় পড়ে গেল সে । চেয়ারম্যানের নাতি হয়ে কেমনে ফ্রি পড়ার দরখাস্ত করবে এমন ভাবনায় তাকে বিচলিত করে তোলে । লেখাপড়া শিখতেই হবে এমনটা আত্মবিশ্বাসে সে এক সময় লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তারই সেই প্রিয় শিক্ষকের নিকট পরামর্শ করে ফ্রি পড়ার দরখাস্ত করে । অন্যান্য শিক্ষকদের সাথেও তার সর্ম্পক ভাল থাকায় হাফ ফ্রি পড়ার সুযোগ দিয়ে কর্তৃপক্ষ তার দরখাস্ত মঞ্জুর করে ।

তার বাবা সংসারে কোনো কাজ করতেন না । তারা পাঁচ ভাইবোন সংসারে ছিল বোঝা স্বরুপ । খেতে/বসতে সবার বুকুনি খেতে হতো । সে ভাইবোনদের মধ্যে বড় ছিল বলে সংসারে অনেকের চোখের চাহনী বুঝত । আর এ কারনেই নিরবে নিভৃতে তার চোখের পানি পড়ে যেত রান্নাঘরে । তার বাবা অসহায়ের মত তাকিয়ে থেকে পরিবারের মানুষের কার্যকলাপ দেখত আর ভাবত আপনজনেরা এতটা নির্দয় হতে পারে ? তার ব্যর্থতার জন্য প্রতিবাদ না করে আধো পেট খেয়ে ক্ষুর্ধাত অবস্থায় বের হয়ে যেত । বাবার দেখাদেখি সেও কোন রকমে বেঁচে থাকার মত খেয়ে বের হয়ে যেত । জ্ঞজীবনঞ্চ যখন আমার কাছে তার পরিবারের এই না বলা গল্পটা শুনাচ্ছিল তখন আমি দেখি তার চোখ দুটি পানিতে ছল ছল করে ভিজে গেছে । আমি তাকে সাহস দিলাম । এখানে বলে রাখা ভাল যে, জ্ঞজীবনঞ্চ এর আবার একটা বদ অভ্যাস ছিল । সে ছিল খুব বন্ধু প্রিয় । বন্ধুদের দেখা পেলে তার পরিবারের কারো কথা মনে হতো না । সকল দুঃখ এক নিমিষেই ভুলে যেত । বন্ধুদের জন্য তার আবেগ, অনুুভূতি ছিল অন্য রকম । জীবন দিতেও কুন্ঠাবোধ করত না । শুধু প্রগ্রাম জানতে পারলে হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ে সে সেখানে যে করে হোক উপস্থিত থাকবেই । ঐ বয়সে বন্ধু বান্ধবের অভাব ছিল না । আর এসব কারনে তার পরিবার থেকে তাকে কেউ পছন্দ করত না । বন্ধুদের মাঝে সে নিজকে বড় করে ধরার জন্য মাঝে মাঝে সে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ম্যাক্সিম গোর্কির গল্প শুনাতো । ম্যাক্সিম গোর্কির বন্ধুরা একবার তাকে বলে ছিল তুমি আমাদেরকে কেমন ভাল বাস ? উত্তরে ম্যাক্সিম গোর্কি বলে ছিল আমার জীবনের চেয়েও । তখন তার বন্ধুরা বলেছিল তুমি যদি তোমার মায়ের কলিজা আমাদের কাছে এনে দিতে পারো তবেই বুঝব যে, সত্যিই তুমি আমাদেরকে ভালবাস । বন্ধুদের কথামত ম্যাক্রিম গোর্কি বাড়ীতে গিয়ে তার মাকে হত্যা করে ফেলল এবং কলিজা নিয়ে যখন দৌড়ে ঘর হতে বের হচ্ছিল তখন দরজার চৌকাঠে হোচট খেয়ে পড়ে গেলে তার হাত থেকে কলিজা টা ছিটকে পড়ে যায় আর কলিজা থেকে আওয়াজ আসলো বাঁছা, তুমি কি ব্যাথা পেয়েছ ? সন্তানের জন্য মায়ের ভালবাসা কতটুকু তা এখানে বোঝা যায় । মাকে খুন করা হয়েছে তাতে মায়ের কোন দুঃখ নেই, ছেলে যে হোচট খেয়ে পড়ে গেছে তাতেই মায়ের কষ্ট । সত্যিই এই হ্নদয় বিদারক উদাহরণ টা এখানে আনার পিছনে অবশ্য কারণ আছে । দুনিয়ার সকল মার ই তো সন্তানের প্রতি এমনই দরদ । অথচ এটা জানা সত্বেও জ্ঞজীবনঞ্চ তার মাকে অফুরন্ত কষ্ট দিয়ে বন্ধুদের জন্য লেখাপড়া বাদ দিয়ে পথে পথে ঘুরত । বন্ধুদেরকে তাদের পরিবারের ভিতরের খবর বুঝতে দিত না । এত অভাবের মধ্যেও তার বন্ধুদের সাথে তাল মিলাতে তার মাকে সব ঝামেলা সইতে হত । বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তার মাকে সে পাগল করে দিত । মা ছিল তার একমাত্র সম্বল । মায়ের বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে মা ও তার সকল আবদার রক্ষা করত । তার বন্ধু সার্কেল ছিল উপজেলার গন্ডি পার হয়ে বাইরেও । সংসারের এমন বেহাল অবস্থাতে তার আবদার মিটাতে তার মাকে সংসারে অনেক অপমান সইতে হয়েছে । তার মা মনের সান্তনা মিটাতে বলত ঐ এখন ভাঙছে আবার ঐ একদিন আমার সংসার গড়ে দেবে । সেও মনে মনে বলত, মা তুমি দোয়া করো অবশ্য একদিন তোমার আশা পুরণ করব । তার কারণে তার মায়ের অপমানের জন্য পরক্ষনে সে মনে মনে বলত কেন সে তার মায়ের কাছে টাকা চাইতে গেল । তার জন্য তার মায়ের এত কষ্ট । সব কিছু বুঝেও এসব কিছু হজম করত সে তার বন্ধুদের জন্য ।


পাঁচ

সে জীবনের অনেকটা বছর হারতে হারতে এখন বেশ বড় হয়েছে, পুরা কৈশোর জীবনে সে শুধু হেরেছে - কিন্ত সে হারেনি কেবল তার আত্ম বিশ্বাসের কাছে । হাটি হাটি পা পা করে করে সে সবেমাত্র কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছে । প্রেম ভালবাসা কি জিনিষ বুঝে উঠার আগেই তার এক বন্ধু নাম আমিনুল তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল । আমিনুল সর্ম্পকে, তার ফুফাতো ভাই, বাড়ী তাদের একই উপজেলায় কিন্ত তাদের বাড়ী হতে ১৫/১৬ কিঃমিঃ দুরে । ধনাঢ্য ব্যক্তি কাশেম সাহেব আমিনুলের দুলাভাই । আমিনুলের বোনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আমিনুল ওর দুলাভাইয়ের বাড়ীতে থেকেই লেখাপড়া করে । সে তখন নিউ টেনে । রীতিমত প্রেমে পড়েছে তাই সে তার বন্ধু জ্ঞজীবনঞ্চকে ও প্রেমের ফাঁদে ফেলতে চায় । জ্ঞজীবনঞ্চ আমিনুলের গালভরা প্রস্তাব প্রত্যাখান করে । জ্ঞজীবনঞ্চ হতবাক হয়ে যায় এই ভেবে যে, এই বয়সে প্রেম, আমিনুলের মাথা ঠিক আছে তো ? আমিনুল রাজকীয় অট্র হাসি দিয়ে তাকে বলেছিল এই বয়সটাতো প্রেম করার উপযুক্ত সময় । লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমিনুল তাকে জানালো সে নিজেও বর্তমানে প্রেমের খালে হাবু-ডুবু খাচ্ছে । আমিনুল তার যুক্তি শক্তভাবে খাড়া করে প্রতিদিন জীবনকে তার প্রেমের কাহিনী শুনাতো । জীবনেরও শুনতে বেশ ভাল লাগত । নারীর উষ্ণ ছোয়া । কিন্ত মনে মনে আবার প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিল । যদি একবার কেহ জেনে যায় তাহলে তার পিঠের চামড়া গরম করে ফেলবে । আর তার বাবার যে রাগ । ছোটবেলায় জ্ঞজীবনঞ্চ তার বাবার এক থাপ্পড়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলেছিল । সেই হতে তার বাবাকে সে ভীষন ভয় পায় । অনেক ভেবে চিন্তে সে আমিনুলকে বলেছিল যাই বলিস না কেন, তার দ্বারা এই বয়সে এই দুরন্ত ঘোড়ার পিঠে উঠা সম্ভব হবে না । কেবল সে নাইনে উঠেছে । লেখাপড়া তাকে শিখতেই হবে । এখানে বলে রাখা ভাল যে, জ্ঞজীবনঞ্চ একটু চঞ্চল ছিল, গায়ে হাড় ছাড়া মাংস ছিল না বলে তার দাদী বলত সে নাকি শয়তানের পিছে দড়ি লাগিয়ে বাতাসের আগে চলে । সে সব সময় খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও অসহায় মানুষদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা তাকে তাড়িয়ে বেড়াত । ছোট বেলা থেকে উচিত কথা বলার অভ্যাস ছিল । ছোট/বড় খেয়াল না করে সত্যি কথাটা প্রকাশ করে দিত । এছাড়া তার আর একটা বদ অভ্যাস ছিল সে হঠাৎ করেই প্রয়োজনীয় কাজ হতে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ত । গরীব মানুষের মুখের প্রতিচ্ছবি তাকে দারুন ভাবে ব্যথিত করত । তাদের কষ্ট দেখলে তার বুকটা ভেংগে চৌচির হয়ে যেত । ভিক্ষুককে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলে সে বুদ্ধি করে তার মা অথবা দাদীর কাছ থেকে ভাত বেশী করে নিত । এজন্য সে তার দাদীর কাছে অনেকবার বকা শুনেছে, তার দাদী বলত তুই নষ্ট করবি এত ভাত খেতে পারবি না । সেতো জানত কি জন্য বেশী নিয়েছে । কিছুক্ষণ পর বলত তার পেট ব্যাথা করছে, আর খেতে পারছে না, এই বলেই ভিক্ষুককে দিয়ে দিত । সামাজিক কিছু কীর্তিকলাপ দেখে মনে মনে ভাবত, মানুষ সামান্য স্বার্থের জন্য মানুষ মানুষের সাথে এরকম আচরণ করে ? খুব ছোটবেলায় চোখের সামনে অভাবে না খেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় মরে যেতে দেখেছে তারই সমবয়সী তাদের পার্শ্ববর্তী গোরা ডাক্তারের ছেলেকে । যুদ্ধের কথা কিছুই মনে পড়ে না তবে এলেম সরদারের বাড়ীতে মুক্তিবাহিনীরা গোলাগুলি করেছে সেই স্মৃতি আজও তার মনে দারুনভাবে রেখাপাত করে । কেননা ঐ যুদ্ধে তার চাচা (সালাম) ও বাড়ীর পার্শ্বের আরেক চাচা (করিম) কে ঘাড়ে করে রাইফেল নিয়ে যেতে দেখেছিল । বড় হয়ে সে শুনেছে সেটাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ । মানুষে মানুষে হিংসা, দ্বনদ্ব, কলহ আর দারিদ্র ক্লিষ্টতা তাকে চরম ভাবে নাড়া দিত । পৃথিবীর নির্যাতিত, লাঞ্চিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত মানুষের পাশে দাড়ানোর ইচ্ছা তার আজম্মের । মানুষের সেবা করার মহান ব্রত সেই ছেলেবেলা হতেই তার মনের মাঝে জমাট বাধতে থাকে । বড় হয়ে একদিন সে তাদের জন্য কাজ করবে এধরনের চিন্তা-ভাবনা সব সময় তার মন মন্দিরে উৎরে উঠত । সমাজের মাতব্বরদের কীর্তিকলাপ দেখে সে সব সময় মনে মনে ভাবত বড় হয়ে সে এ সমাজ পরিবর্তন করবে । শোষণহীন, বন্ধনমুক্ত এক পৃথিবী গড়ার ইচ্ছা তার লালিত স্বপ্ন । অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে আঘাত হেনে পৃথিবীকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুখ প্রদ করবে । ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় এটৗই তার একমাত্র চাওয়া পাওয়া । তার এক কথা জীবনে যদি অবহেলিত, লাঞ্চিত, শোষিত মানুষের পাশে যেয়ে দাড়াতে না পারলাম তাহলে এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করা তার বৃথা হয়ে যাবে । একবার তাদের বাড়ীর বৈঠকঘরে বিশাল এক শালিস বসেছে যেখানে তার নানাও উপস্থিত ছিল । তখন সে ফাইভে পড়ে । এক পর্যায়ে সে লক্ষ্য করল তার নানা ঐ শালিসে যে সিদ্ধান্তটা দিতে যাচ্ছে সেটা অনেকটা পক্ষপাতমুলক । ঘটনাটা সর্ম্পকে গ্রামের অনেকেই অবহিত ছিল, তাই তার নানার মতামত দেয়ার আগেই সে ঐ মজলিসে তার নানাকে প্রশ্ন করেছিল বিচারকের কয়টি গুন থাকতে হয় ? পাশের থেকে আর এক মাতব্বর তাকে ধমক দিয়ে বলে উঠল, তুমি বিচারের কি বুঝ? বড়দের সম্মান কর না ? তাছাড়া উনিতো তোমার নানা । যে শালিসে তোমার দাদাও বসে আছে সেখানে এই বয়সে তুমি কিভাবে কথা বল ? অন্য আর একজন বলে উঠল এসব হলো চরম ফাজিল । নানাকেও সম্মান করতে জানেনা । সর্ম্পকে জ্ঞজীবনঞ্চ এর খালু হয় উনি একটু বাকাঁ চোখে বললেন, তুমিই বল বিচারকের কয়টি গুন ? জ্ঞজীবনঞ্চ তার রাজ্জাক চাচার কাছ থেকে বানী চিরন্তনী বইতে পড়েছিল বিচারকের গুনাগুনের কথা, তাই সে সবার সামনে বিখ্যাত লেখক সক্রেটিস এর বানী বিচারকের সেই চারটি গুনাগুনের কথা গড় গড় করে বলে দিল (১) বিনয় সহকারে শোনা (২) ঞ্চানীর মত উত্তর দেয়া (৩) সংযত হয়ে বিবেচনা করা (৪) এবং কোন দিক পক্ষপাতিত্ব না করে বিচার করা । পাশে ফিস ফিস করে একজন বলল, কাটা হুল হয়েই বের হয় । গাজী সাহেবের নাম রাখতে পারবে কিন্ত ওর বাবাতো একেবারে নরম মানুষ, সদানন্দ। ও এরকম হলো কিভাবে ? ওর দাদা সেদিনই শুধু এত মানুষের সামনে ওকে কিছুই বলেনি । কিছুটা ভাল ব্যবহার করে বলেছিল, যাও তোমার এখানে থাকার দরকার নেই । পাশ থেকে একজন রসিকতা করে ওর দাদাকে বলল, ও তো আপনার সেক্রেটারী । থাকুক না, অসুবিধা কোথায়। খারাপ কিছুতো বলেনি । ওরা এখন না থাকলে শিখবে কিভাবে ? তার এক চাচা বলে উঠল, শেখার অনেক সময় রয়ে গেছে । এ সমস্ত ইচড়ে পাকা, যারে বলে ফাজিল, একেবারে ৪২০ । সে একটু প্রতিবাদী হওয়ার জন্য অনেকের কাছে ৪২০ নামেই পরিচিতি পায় ।



ছয়

রক্তের সর্ম্পক মানুষকে কত কাছে টানে । রশিদ, আমিনুল ও জ্ঞজীবনঞ্চ । সর্ম্পকে তারা মামাতো/ফুফাতো ভাই । সেই একেবারে ছোটবেলা থেকে তাদের তিনজনের মেলামেশা। এক অন্যরকম হ্নদ্যতা । একই বৃন্তে ফোটা যেন তিনটি ফুল । পৃথক হবার নয় । কোথাও গেলে, কিছু খেলে এমনকি এক গ্লাস পানি তারা তিন জন ভাগ করে খেয়েছে । তারা তিনজন সবসময় মানুষের বাঁকা চোখে থাকত । অনেকে সরাসরি বলত এই তিনটা পুরো ফাজিল এবং নাম্বার ওয়ান ৪২০ । প্রতি পদক্ষেপে এই উপাধি তাদের একেবারে পাওনা ছিল । অবশ্য তখন এর অর্থ সে বূঝত হয়ত তারা তিনজন এই সমাজের উচ্ছিষ্ট এবং সবচেয়ে খারাপ ছেলে । এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় রেখে, লোকে খারাপ বলবে এই ভেবে প্রেম না করার জন্য আমিনুলকে সে অনেকবার বুঝাবার চেষ্টা করে । জ্ঞজীবনঞ্চ এবং রশীদের চেয়ে আমিনুল ২/৩ বছরের বড় হওয়ায় সে তখন পুর্ন যৌবনে পর্দাপন করেছে । সে প্রেম কি জিনিস বুঝতে শিখেছে । প্রেম যন্ত্রনায় হাবু-ডুবু খাচ্ছিল। তাই জ্ঞজীবনঞ্চ এর মিষ্টি কথার রসগোল্লা আমিনুলের ভাল লাগল না । জ্ঞজীবনঞ্চ এর হালকা যুক্তি তার কাছে ধোপে টিকল না । তুবও সে আমিনুলকে বুঝাতে চাইলো, তার জীবনে অনেক কলংক আছে । স্কুল ফাকি দেয়া থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে দু লাইন বেশী বুঝা । সুতরাং এই অপবাদ সে ঘুচাতে চায় । তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছাত্র জীবনে প্রেম করবে বই এর সাথে আর বিয়ের পর প্রেম করবে বউ এর সাথে । কিন্ত আমিনুল নাছোড় বান্দা । ইনিয়ে বিনিয়ে মিষ্টি মধুর প্রেমের সুড়সুড়ি আর কথার ফুলঝুরি দিয়ে প্রেমের দিকে সে জ্ঞজীবনঞ্চ কে আকৃষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে ।

হেমন্তকাল চলছে । মৃদ শীতের আমেজ বইছে, হালকা হালকা শীত । সবুজ ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে । সে এক অন্য রকম মনোরম দৃশ্য । পৌষের আমন্ত্রন । শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে একান্ত নিরিবিলি জ্ঞজীবনঞ্চ ও আমিনুল বসে আছে । এই নদীর একদিন প্রমত্ততা ছিল । ছিল তার একটা ইতিহাস, এখানে এক সময় লঞ্চ চলত । কুমীরের এক নির্জন আবাসস্থল । কুমিরের ভয়ে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে কেউ একা চলতে সাহস করত না এই নদীতে । এখন এসবের কিছুই নেই, সে শুধু স্মৃতির পাতায় এক মরা নদী । দুই গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় এক মনোরম পরিবেশে নদীর পাড়ে প্রতিদিন বিকালে এসে ওরা বসে। সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের গল্প নিয়ে তারা সেখানে ব্যস্ত থাকত । আর তাদের এখানে আসার একটা কারণও ছিল । চারিদিকে ধান থাকার কারনে তাদের খেলার জায়গা ছিল না বলেই অগ্যতা তাদের মিলনস্থল ছিল বিলের সেই মাঝামাঝি ফাকা রাস্তায় । এখানে বসে পরিকল্পনা করত কিভাবে ভাল কাজ করে তাদের দুর্নাম কিছুটা হালকা করা যায় । কিভাবে মানুষ হবে। সংসারে এত অভাব, তাছাড়া পরিবারের একটা মান সম্মানও আছে । সে ভাবে সর্তকতার সাথে পা ফেলে এগুতে হবে এবং কাজ করতে হবে । এছাড়া তারা আরও মজার দুষ্টমীর পরিকল্পনা করতো কবে কোনদিন আনসার গাজীর বাগানের নারিকেল পাড়তে হবে । আর কোন দিন পিকনিক করতে হবে । তারা তিনজন একে অপরকে বন্ধুর পরিচয় দিয়ে স্বস্তিবোধ করত। আনসার গাজী রশীদের পড়শী, চাচা সর্ম্পক হলেও জ্ঞজীবনঞ্চ এর সর্ম্পক আরো ঘনিষ্ট অর্থাৎ তার নানাবাড়ী । একই শরীকে রশীদ ও জ্ঞজীবনঞ্চ এর নানাদের বাড়ী । তাদের সমবয়সী জ্ঞজীবনঞ্চ এর বেশ কয়েকজন খালাও ছিল । তাদের কেহ কেহ তাদের এই অপারেশনে মাঝে মাঝে যোগ দিত । জীবনের অনুভূতিতে ছেলেবেলায় খালাদের সাথে নারিকেল চুরি করে খাওয়া এক অন্যরকম আনন্দ । বাড়ীর গাছের নারকেল সবার সামনে পেড়ে খেলে এরকম মজা লাগে না । তার দাবী ঐরকম বয়সে কে না নারকেল চুরি করে খেয়েছে ? তার একদিনের নারকেল চুরির বৃত্তান্ত আমাকে এভাবে জানিয়ে ছিল - তার নানাদের পুকুরের দুই ঘাটে শান বাধানো ছিল । একদিন রাত দশটা/সাড়ে দশটার দিকে তারা তিনজন পুকুরের উত্তর প্রান্তের নারিকেল গাছে অপারেশন চালাচ্ছে । আমিনুল গাছের মাথায় উঠে গেছে, রশীদ গাছের মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে । আর জ্ঞজীবনঞ্চ আমড়া কাঠের ঢেকি বলে তাকে নিচে বসে নারকেল ধরে নেয়ার দায়িত্ব ছিল । পুকুর পাড়ে তাদের উপসিহতিতে কুকুর ছুটাছুটি ও ডাকাডাকি শুরু করে দিল । এমন সময় কাশেম সাহেবের বড় বউ আংগুরী বেগম রাতের খাবার খেয়ে রান্নাঘরের হাড়ি পাতিল গুছিয়ে বাড়ীর কাজের লোককে সাথে নিয়ে পুকুরে এসেছে ওযু করতে । কাজের লোকটির নাম ইউসুফ । দুর্বল প্রকৃতির হওয়ায় আদর করে ঐ বাড়ীর সবাই তাকে ফুলু ইউসুফ বলে ডাকতো । তার চেহারার সাথে নামের বেশ মিল ছিল । কুকুরের ডাক শুনে এবং গাছের খড় খড়ানি শব্দে আংগুরী বেগম এবং ইউসুফ আচ করলো নিশ্চয় গাছে কেহ আছে । আংগুরী বেগম সন্দেহ বশতঃ আবার বলল, না ! এত সন্ধ্যা রাতে চুরি করতে কারোর সাহস হবে না । বাতাসে হয়ত গাছের ডাল নড়ছে। ফুলু ইউসুফ এবার তার বাহাদুরীর গল্প বলা শুরু করল । বলল, ভাবী তুমি আমার সাহস সর্ম্পকে জান ? আমি আই বি ক্যাম্পের পাশে একবার এক ফরেষ্টারের বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়ে দুজন ডাকাতকে চরের মধ্যে পুতে ফেলে ছিলাম । আংগুরী বেগম মুচকি হাসি মেরে কথার ভিতর বাম হাত দিয়ে বলল, কই তোর এরকম ঘটনাতো আমরা কেউ কোনদিন শুনিনি। ফুলু ইউসুফ বলল, ভাবী তুমি জান না, আমাকে একটা বন্দুক দাও, দেখবে তোমাদের গাছের নারকেল আর কেউ চুরি করতে পারবে না । চোর সব মেরে আমি সাবাড় করে দেব । অবশ্য তাদের এই কথোপকথনের ভিতরেই দু কাঁদি নীচে নামানো শেষ । ফুলূ ইউসুফের গাল গল্প শুনে আমিনুল গাছের মাথায় বসে রশিদকে আস্তে আস্তে বললো, গল্প শুনিস । রশিদ ফিক করে হেসে দিল । আর নীচের ছাগলটাকে থামায় কে ? অর্থাৎ জ্ঞজীবনঞ্চ একটু গর্দভ টাইপের ছিল । ওদের হাসি শুনে তার হাসিটা একবার জোরে বাষ্ট হয়ে গেল । কুকুর আবার ওদের দিকে ডেকে আসল । আমিনুল ফিস ফিস করে রশিদকে বলল, তাড়াতাড়ি নেমে পড় । ওয়েটলেস তো দৌড়ে পালাবে আর আমরা নিশ্চয় আজ ধরা খেয়ে যাবো । কুকুরের ডাক শুনে জ্ঞজীবনঞ্চ অন্য এক গাছের নীচে আশ্রয় নিল । এদিকে ওরা তাড়াহুড়া করে নেমে দিল দৌড় । জ্ঞজীবনঞ্চ গাছের নীচে গিয়ে দেখে দুটি নারকেল পড়ে আছে । সে ও দুটো নিয়ে ওদের পিছনে পিছনে ছুট দিল । কুকুর তাদের তিন জনকে ধাওয়া করেছে । ফুলু ইউসুফ এবার বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বললো, ভাবী তোমার না বললাম, গাছে চোর আছে । তুমি তো বিশ্বাস করলে না । আরে ভাবী, আমরা সুন্দরবনে ডাকাত চরাই খাই । আংগুরী বেগম বলল, আরে ইউসুফ তোর গাল গল্প রাখ । ইউসুফ মন খারাপ করে বলল, ভাবী এই তো দিলে সব শেষ করে । কুকুর এবং মানুষের হাতে ধরা খাওয়ার ভয়ে বেড় লাফ দিতে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে রশীদ পড়ে গেল বেড়ের ভিতর । জ্ঞজীবনঞ্চ এর লাফ দিতে সাহস হয়নি তাই সে বেড়ের নীচ দিয়ে পার হওয়ার সময় দেখল রশীদ পড়ে গিয়ে হাসছে । সে ওর পিঠে পাড়া দিয়ে বলল, শালা তুই এখানে পড়ে থাক । তোর জন্য প্রায় তো ধরা খেয়েছিলাম । মজার ব্যাপার হলো সেই রাতে নারকেল খাওয়ার জন্য তাদের কাছে দা ছিল না । অগ্যতা দাঁত দিয়ে নারকেল সাইজ করতে হয়েছিল আর কাঁচি দিয়ে কাটতে যেয়ে জ্ঞজীবনঞ্চ এর বাম হাতের বৃদ্ধাংগুলে কোপ লেগেছিল । শীতের রাত, সারারাত যন্ত্রনায় ছটফট করেছে । হাতের যন্ত্রনায় সেদিন তার আর নারকেল খাওয়া হয়নি । সেই স্মৃতি আজও তার আংগুলে রয়ে গেছে । ছেলে বেলায় নারকেল চুরির স্মৃতি তাকে আজও বেশ পুলকিত করে ।


আট

জ্ঞজীবনঞ্চ এর প্রতিটি ক্ষেত্রে ৪২০ উপাধি পাওয়ার পিছনে যে সমস্ত ঘটনাগুলো কাজ করেছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য এখানে কিছু ব্যাক গ্রাউন্ড নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন । তাহলে সকলের সহজে বুঝতে সুবিধা হবে । তার নানারা ছিল চার ভাই । জীবনের নানা দ্বিতীয় । সেজ নানা বাদে সবারই দুই বউ ছিল । সে ছিল প্রথম পক্ষের । মামারা ছিল দ্বিতীয় পক্ষের । তার ছোট নানী ছিল দুরন্ত বদ মেজাজের । তাকে একেবারে সহ্য করতে এবং দেখতে পারত না। নানা/মামাদের ভালবাসার ছোয়া তার জীবনে কখনো লাগেনি । মামা বাড়ীর আনন্দ, নানা নানীর সেনহ ভালবাসা কে না পেতে চায় ? সে খুব চেষ্টা করেছে নানা/নানী, মামা/মামীদের একটু কাছে যাওয়ার । কিন্ত তারা তাকে কখন পাত্তা দেয়নি । তার নিজের নানী ছিল খুবই সোজা প্রকৃতির । একেবারে সেকালের । খারাপ কথা বার্তা, চিন্তা ভাবনা কি সেটা সে বুঝত না । তাকে দুমঠো ভাত খাওয়ানোর জন্য সে পাগল হয়ে যেত । মাঝে মাঝে তার আবদার রক্ষা করার জন্য সে চুরি করে তার নানীর ঘরে বসে খেয়ে আসত । কিন্ত যদি তার ছোট নানী দেখে ফেলত তাহলে তার আর রক্ষা ছিল না । তার নানীর সাথে ঝগড়া শুরু করে দিত। সে নিজকে খুব ছোট মনে করত । কেন সে আসল আর কেনইবা খেতে গেল ? এসব প্রশ্নবানে সে নিজকে জর্জরিত করত। তার বড় নানার মেয়েরা অর্থাৎ খালারা ছিল তার পক্ষে । তার বড় নানার মেয়ে খালেদা ছিল তার সমবয়সী, ছোট বেলা থেকে তার সাথে পুতুল খেলতে খেলতে বড় হয়েছে বলে খালেদার সাথে তার খুব সখ্যতা এবং খালেদাও তাকে খুব আদর করে । তার ছোট নানীর ব্যবহারে জীবন কষ্ট পেত তাই খালেদা তাকে সান্তনা দিত । প্রতিদিন সে বাড়ী থেকে খেয়ে তারপর আমিনুল ও রশীদের কাছে যেত । সেই ছোট বেলা থেকে মনের গভীরে এক প্রচন্ড কষ্ট, বেদনা, দুঃখ আজও সে বয়ে বেড়াচ্ছে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর সেই ছোট নানী আজ আর দুনিয়াতে নেই । জীবন অনেক বড় হয়েছে তার পৃথিবী বদলে গেছে । তাই সে তার নানীর জন্য প্রান খুলে দোয়া করে তিনি যেন জান্নাত বাসিনি হয়। কিন্ত তার নানা এবং মামারা আজও তার সাথে সেই একই রকম আচরণ করে । অথচ এখন তাদের সেই জমিদারী নেই । তার নানাকে এখন দুমুঠো ভাত খাওয়ার জন্য ছেলের বারান্দায় বসে দিন শেষ করে অথবা মেয়ের জামাইয়ের বাড়ীতে কামলা দিয়ে খেতে হয় । নানার জন্য তার খুব কষ্ট হয় । মামাদের নামে অনেক আগেই তার নানা সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন । তার ছোট মামা আজ আর নেই । বিধবা মামী এবং এতিম বাচ্চাদের জন্য তার অনেক কষ্ট হয় । বিধবা এবং এতিমের কষ্ট জ্ঞজীবনঞ্চ হাড়ে হাড়ে অনুভব করে । মামী একদিন দুঃখ করে বলেছিল, জ্ঞজীবনঞ্চ তোমার নানা এবং মেঝ মামা আমাদের সাথে খুব র্দুব্যবহার করে । জায়গা জমি ফাকি দিয়ে নিতে চায় । তার মেঝ মামার কথায় তার নানা উঠা বসা করে । অথচ সেই মেঝ মামাই এখন তার নানাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে । তার নানা এখন খেয়ে না খেয়ে কোনমতে বেচে আছে । জীবনের শেষ প্রান্তে আসলেও মানুষটির আজও হুস হয়নি ।



নয়

ডিসেম্বর মাস শেষ, ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে । রশীদ আর জীবন ক্লাশ টেনে উঠেছে, আমিনুল এসএসসি পরীক্ষার্থী । তাদের মেলা মেশার মাত্রা আরও বেড়ে গেল । দিনে দিনে জ্ঞজীবনঞ্চ এর নানা/মামাদের সাথে তার সর্ম্পক আরও সাপে নেউলে হয়ে উঠতে লাগল । অবশ্য এর কারণও একটা ছিল । জীবনের ছোট চাচার এক বন্ধু নাম আবেদ আলী তার সেজ নানার মেয়ে অর্থাৎ চাচাতো খালার সাথে প্রেম করে ছিল । এটা জানা জানি হয়ে গেলে তার সেজ নানী আবেদ আলীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিল । কাকুর বন্ধু হিসেবে আবেদ সাহেবকে জ্ঞজীবনঞ্চ চাচা বলেই ডাকত । যদিও আবেদ সাহেব তাদের অন্যদিক থেকেও আত্মীয় হতো । এই আবেদ সাহেব ছিল অনেকটা বাস্তব বাদী । অল্প বয়সে পোড় খেতে খেতে তিনি অনেকটা কঠিন হুদয়ের মানুষ ছিল । তিনি খুব সাহসী, দুরন্তপনা এবং লিডার টাইপ ছিল বলে জ্ঞজীবনঞ্চ এর কাছে খুব প্রিয় ছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ আবেদ সাহেবকে খুব পছন্দ করত । জ্ঞজীবনঞ্চ এর নানীর উল্টা পাল্টা কথা বার্তা আবেদ সাহেবদের সহ্য হয়নি তাই তারা কয়েক বন্ধু মিলে তার খালাকে স্কুল হতে আসার সময় জোরপুর্বক উঠিয়ে নিয়ে যায় । ঘটনার সময় জ্ঞজীবনঞ্চ এর দাদা তখন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান । তার নানারা সবাই ঘটনা নিয়ে ছুটে আসল তার দাদার কাছে । দাদার সাথে সেও চলে গেল আবেদ সাহেবদের বাড়ীতে । তার খালা একটা ছোট রুমে বসে কাঁদছে । এটা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই তারও খুব কষ্ট হলো । সেই খালাও তাকে খুব আদর করত । জীবন চুপে চুপে কোন মতে জানালার কাছে গিয়ে ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করল, যে করেই হোক তাকে নিয়ে যাবে । খালার কান্না দেখে আবেদ সাহেবের উপর তখন তার প্রচন্ড ঘৃনা জন্মালো । সে তখন অনেক ছোট । এখানে বলে রাখা ভাল যে, ( নাম্বার ওয়ান ৪২০ হওয়ার কারণ হিসাবে এগুলি সে বর্ননা করছিল)। সারারাত ধরে সালিশ বিচার করে সিদ্ধান্ত হলো তার খালার সাথে আবেদ সাহেবের এখন বিয়ে হবে এবং জামাই মেয়ে মেনে নিয়ে তার নানারা বাড়ীতে নিয়ে যাবে । নতুন আত্মীয়তায় তার মনের বিষাদ চলে গেল । সে খুব খুশী হলো । কিন্ত তার নানা আনসার গাজী আবার একটু প্যাচ দিয়ে প্রস্তাব দিল জামাই মেয়ে হিসাবে মেনে নিলাম কিন্ত বিয়ে হবে মেয়ের বাড়ীতে । সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরের দিন সকালে তার খালা ও আবেদ সাহেবকে জামাই হিসেবে ফিরিয়ে আনা হলো । তার নানাদের বাড়ীতে আবেদ সাহেবকে এক সপ্তাহ রাখার পর বিয়ে ছাড়া বের করে দেয়া হলো । পরবর্তীতে তার নানারা মেয়ে হাইজ্যাক করার কারনে হাইজ্যাকের সাথে জড়িত সবার নামে কেইস করে দেয় । জ্ঞজীবনঞ্চ এর ছোট চাচা আসামী হলো এবং আরও অনেকে । তাদের বাড়ীতে মিটিং বসল । স্বাভাবিক কারনে সে তার চাচার পক্ষ নিয়ে একদিন তার সেজ নানীকে প্রতিবাদের সুরে অনেক কথা শুনিয়ে দেয় এবং হুমকিও দেয় যে, তার কাকুর নামে কেইস করা হয়েছে সুতরাং তাদেরকে ছাড়া হবে না । সেজ নানা/নানীর কাছে সে হয়ে গেল চরম শএু । তার সেজ নানীও কাউকে ছেড়ে কথা বলে না । ওকে যাচ্ছে তাই বলে গালি দিয়েছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ প্রতিবাদী ছেলে তাই সেও তার নানীকে বলেছিল হেরে যাবার জন্য তার জন্ম হয়নি । জ্ঞজীবনঞ্চ প্রতিদিন খেলা করতে এসে যা শুনত তা বাড়ীতে যেযে সবাইকে বলে দিত। তার নানারা তার মাকে ডেকে প্রায়ই নালিশ করত । সে যা করত না, সেগুলিও বানিয়ে বলে তাকে মার খাওয়ানো হতো । এ কারনে তার মনে আরও জেদ বেড়ে গেল । সে তার সেজ নানীর সাথে ঝগড়া করার জন্য শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক কিছু বলত। আমিনুল প্রেম করে তার ঐ সেজ নানীর এক মেয়ের সাথে অর্থাৎ তার আরেক খালার সাথে । প্রতিদিন কি গল্প করে, কোথায় বসে গল্প করে, কি কি কথা হয়েছে, কি কি পিঠা খেয়েছে এসব ফিরিস্তি কাব্যিক ভাষায় তার কাছে বর্ননা করত । ওর প্রেমের গল্প জ্ঞজীবনঞ্চকে না বলে আমিনুল থাকতে পারত না। আরও বলত এই আনন্দের কথা যদি তোকে না বলতে পারি তাহলে সেও কোন কাজে আনন্দ পায়না এবং পড়া শুনায় একেবারে তার মন বসে না । জ্ঞজীবনঞ্চও সেই প্রেমের উপ্যাখান শুনে আনন্দবোধ করত আর মনে মনে ভাবত যদি আমিনুলের মত তাকেও কোন মেয়ে এভাবে ভালবাসতো তাহলে তার ভাংগা গড়া জীবনটা বদলে যেত । কিন্ত জীবনের এই কল্পনা কখনো আমিনুলকে বুঝতে দিত না । আমিনুুলের ভালবাসার প্রিয় মানুষটি আর জ্ঞজীবনঞ্চ ছিল প্রায় সম বয়সী । তাই একদিন সুযোগ বুঝে জ্ঞজীবনঞ্চ তার খালাকে বলেছিল সে সব জানে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর উপর ভীষন রেগে তার খালা বলেছিল তুই কি জানিস ? সে কৌতুক করে বলেছিল গত রাতের পিঠা সেও খেয়েছে । জ্ঞজীবনঞ্চ ঘটনা জেনে গেছে সেটা তার খালা ভালভাবে নেয়নি । পরে আমিনুলের কাছে সে শুনেছিল তার উপর সিডরের ন্যায় গজব নাজিল হয়েছিল । সত্যি সেদিন বিকালে সে আমিনুলকে দেখেছিল মুখটা বাংলা পাঁচের মত করে রেখেছে । হয়ত বিকট আওয়াজ করে তা এখনই ফেটে যাবে । গম্ভীর কন্ঠস্বর । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনে হলো সে ওর কাছে বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে । অপরাধ জানতে চাইলে সে বলল তোকে আর কিছুই বলা যাবে না । আমার প্রেম শেষ, সব কিছু মিছাকার করে দিলি । তার পর সুর একটু নরম করে আমিনুল বলল, অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি । শুধু তাই নয়, সাবধান করে বলল, তুই আর কোনদিন ধরা দিস না । না জানার ভান করে থাকিস । জীবন ঘাড় নেড়ে তার সুরে বলল যা তোর প্রেমের কথা নাই বা শুনালি । এবার আমিনুল বলল, না তোকে আমি সেভাবে বলিনি । আরে তুই রাগ করেছিস নাকি ? ধ্যাত, ওরকম মেয়ে জীবন থেকে চলে গেলে কোন আসে যায় না কিন্ত তোর মত বন্ধু সারা জীবনে আর একটাও খুজে পাবো না । বুঝলি, তুই মাইন্ড খাস না । জ্ঞজীবনঞ্চ মনে মনে বলে সবাই শত্তেুর ভক্ত, নরমের জম । যাইহোক, ইতিমধ্যে ঘটনাটা রশিদ ও জেনে গেছে । আমিনুলের প্রেমিকা অর্থাৎ জীবনের খালা রশীদের চাচাতো বোন । রশীদদের সাথে জীবনের নানাদের সর্ম্পক ভাল না । রশীদদের সকল জায়গা জমি তারা ফাঁকি দিয়ে নিয়েছে এবং বর্তমানে যা আছে সেটুকুও নেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে । বিভিন্নভাবে রশীদদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে । রশীদদের সংসারে তখন চরম অভাব চলছে । রশীদের বাবা অর্থাৎ জীবনের ফুফা কিছু করতেন না। সামান্য কিছু জমি ছিল । তার উপর সবাইকে নির্ভর করতে হতো। কোন ওয়াক্তে আটার রুটি , কোন ওয়াক্তে আটার জাউ এবং কখনো কখনো উপোষ যেত । জীবন তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী । মাঝে মাঝে সেও ওদের আটার জাউ এবং ডাল ভাতের মেহমান হয়ে যেত । কখন কখন তাদের কষ্টের কথা ভেবে সে না খেয়ে রশীদের জন্য ওদের বৈঠকঘরে শটান হয়ে অপেক্ষা করত এবং খেলাধুলা শেষ করে একেবারে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরত । তখন সে এতটা বুঝত না কিভাবে ওদের সংসার চলছে । এত কষ্টের পরও রশীদের মা অর্থাৎ তার দাদার ছোট বোনের মেয়ে সেই ফুফু কোনদিন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি । রশীদ ছিল তার জ্ঞজীবনঞ্চ এর সর্বস্ব তাই রশীদ ও তার মা উপলব্ধি করে জ্ঞজীবনঞ্চ কে তেমন প্রেসার দিত না বরং তার ভালবাসাটা তারাও অনুভব করলে ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই রশীদকে জ্ঞজীবনঞ্চ এর সাথে মেলামেশা করার ব্যাপারে চাপ ছিল । অবশ্য জ্ঞজীবনঞ্চ দের বাড়ী থেকে রশীদ ও আমিনুলের সাথে মেলামেশা করা কঠোর নিষেধ ছিল । তাদের উভয় ফ্যামিলিতে সবার ধারনা ছিল তারা এভাবে মেলা মেশা করলে কারোর লেখা পড়া হবে না । রশীদের মা অর্থাৎ জ্ঞজীবনঞ্চ এর ফুফু আজও বেঁচে আছে । আজ আর তাদের অর্থের কমতি নেই । ফুফুকে জ্ঞজীবনঞ্চ কখনো ভুলবে না । এমন মানুষ দুনিয়াতে কঞ্চজন হয় ? কঞ্চজনের ভাগ্যে জোটে এমন ফুফু? রশীদের মা ছিল তার জীবনের দুঃসময়ের ফুফু , তার অহংকার ।




দশ

পড়ন্ত বিকাল, হেমন্তকালের শেষ দিকে, শীতের আমেজ, সুর্য্যের লাল রংয়ের আভা । প্রাকৃতিক এই দৃশ্য সত্যিই মনোরম। আর কিছুক্ষণ পরেই সুর্যটা তলিয়ে যাবে পৃথিবীর অপর প্রান্তে। আমিনুল আর জ্ঞজীবনঞ্চ একান্তে বসে আছে । কোন কথা নেই দু জনের মধ্যে । অনেকক্ষণ চুপ করে রইল আমিনুল । জ্ঞজীবনঞ্চ প্রথমে মুখ খুলে বলল কিরে তোর মন খারাপ নাকি ? সে গম্ভীর হয়ে বলল, তোকে একটা কথা বলতে চাই কিন্ত তুইতো কোনদিন সাহস দিলে না, তাই ভাবছি কিভাবে কথাটা শুরু করি? জ্ঞজীবনঞ্চ অভয় দিয়ে বলল, মদন তোর ভনিতা রেখে এখন বল কি বলবি । ও বলল, তোকে একটা প্রেমের কথা বলেছিলাম, তুইতো কোন সাড়া শব্দ করলি না । জ্ঞজীবনঞ্চ বলল কেন, তোকে কেউ কি ঘটক বানিয়ে পাঠিয়েছে ? তুই তো রাজরানীর নাম বলছিস না । মেয়েটির নামটাতো আগে জানতে হবে । তোর কথার সুর ধরে কয়েকদিন ধরে খুজলাম কিন্ত কোন মেয়ের সন্ধান পেলাম না । আর তাছাড়া এখন আমাদের সংসারের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে । এই মুর্হুতে কেউ আমাকে ভালবাসতে চাইবে না । যাদেরকে আমি পছন্দ করি তাদের কাছে সাহস পাইনা । নাই অর্থ , বয়স কম্‌, তাই ভাবছি যদি কোনদিন লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হতে পারি তাহলে প্রস্তাব দেব। ও বলল, তোকে ভাবতে হবে না, তোর মতামত থাকলে বাকী সব আমি ম্যানেজ করব । জ্ঞজীবনঞ্চ ওকে বলল, তা আমার সেই রাজরানীর নামটি কি জানতে পারি ? ও হেসে বলল, যখন তোর মনে এত জ্বালা তখনতো নাম অবশ্য বলতেই হবে, বলেই অমনি ছাগলের মত খিলখিল করে ফোকলা দাতে বললো, মমোতাজ । আর মাস খানেকের মধ্যে বেড়াতে আসবে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর বুকটা চমকে উঠল । সে বলল এ কখনো সম্ভব না । ওরা কখনো আমাকে দেবে না । আমরা প্রায় সম বয়সী । আমার লেখাপড়া শেষ করতে করতে ওর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে । আর ততদিন সেকি আর আমার মত ছন্নছাড়া মানুষের অপেক্ষায় থাকবে ? আর তাছাড়া আপন খালাতো বোনকে কিভাবে বিয়ে করি ? ওকে তো আমি বোনের মত মনে করি । আমার মনে হয় সেও আমাকে বড় ভাই হিসেবে জানে । আমিনুল বলল, তোর ভাবনায় ভূল আছে, তোকে ভাবতে হবে না । মেয়ে যদি পক্ষে থাকে তবে কেউ কিছু করতে পারবে না । আগে আসুক তারপর খালেদাকে দিয়ে সব ঠিক করে ফেলব । মুর্হুতের মধ্যে জ্ঞজীবনঞ্চ এর ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল । সে তার হ্নদয়ে স্বর্গীয় কোন বাতাস অনুভব করল । আমিনুল এর কাছে সে একটু লজ্জাও পেল । আমিনুলের চোখ এড়ালো না । আমিনুল বাঁকা চোখে ব্যঙ্গতার সুরে হাসি দিয়ে বলল, তোকে লাজুক লাজুক দেখাচ্ছে । সে নিজকে সামলে নিয়ে বলল, ধ্যেত, লজ্জা পাবো কেন রে ? আমি পুরুষ মানুষ না ? হ্যাঁ পুরুষ মানুষ, তবে তোর পুরুষের সামনে কা লাগিয়ে দিলে মানাবে বেশ । যে পুরুষ প্রেমের কথা শুনে আমার কাছে লজ্জা পায় সে তো তাজের সামনে গেলে দু কলস প্রস্রাব করে দেবে । দেখিস আবার যেন কাপড় ভিজিয়ে আমার বদনাম করিসনে । সেও কম যাবার নয়, বলল তোর মত ঘটক পাশে থাকলে কারো ভরসা নেই, বুঝলি । ততক্ষনে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে । সেদিনের মত বৈঠক শেষ করে সন্ধ্যায় দু জন দু দিকে রওনা দিয়ে যার যার বাড়ীতে চলে গেল। হাটতে হাটতে জ্ঞজীবনঞ্চ প্রেমের রাজ্যে ডুব দিয়ে কল্পনার অতল সমুদ্রে ডুবে গেল । বাড়ীতে এসে হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসল কিন্ত পড়ায় তার মন বসলো না । শুধু তার ঐ এক ভাবনা । কবে, কখন তাদের দেখা হবে, সে কেমন দেখতে হয়েছে, রুপসী তো বটেই । তবে কিভাবে প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব দেবে, সে কি প্রস্তাব গ্রহন করবে ? না ফেরত দেবে ? এই চিন্তায় সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে । সেদিন আর পড়া হলো না তার, খাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই, রাতে ভালো ঘুম হয়নি । জীবনের প্রথম প্রেম, অন্যরকম এক আনন্দ অনুভূতিতে সে রাত পার করেছে । সেই রাতে জেগে জেগে তার সেই স্বপ্ন দেখা আজও তার মনকে ভীষনভাবে নাড়া দেয় । পরের দিন সকালে উঠে চলে গেল প্রথমে রশীদের কাছে । রশীদকে বলার জন্য তার মনটা এ্যাবড়ে থ্যাবড়ে করছে । যেন আর তর সইছে না । রশীদকে বলল তার সব ঘটনা । ও শুনে বলল, বেশ ভাল হয়েছে । সে ওকে সংগে করে আমিনুলের কাছে যায় । তারা তিনজন মিলে খালেদার কাছে বলে । খালেদা শুনে খুব খুশী হলো । সে নিজেও একটার পর একটা প্রেম করতে খুশী এবং অপরের প্রেমে নাক গলাতেও খুশী । সে বলল সব আমি ব্যবস্থা করব । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনে প্রশান্তির বাতাস বইছে । তাকে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি সে । তাজ কে নিয়ে তার সারাক্ষণ চিন্তা চেতনা । এখন তার আর কোন কিছুতে মন বসে না । মন মন্দিরে শুধু উদ্ভাসিত হয় তারই প্রতিচ্ছবি । কল্পনার জগতে সে এক মহানায়ক । সে তাকে ভালবাসে তার মত করে । তার শয়নে স্বপনে শুধু তারই প্রতিচ্ছবি । জ্ঞজীবনঞ্চ এর সময় আর কাটতে চায়না । কবে তাকে কাছে পাবে । কেমন করে প্রথম কথাটা শুরু করবে । আবার যদি সে তাকে গ্রহন না করে । হাজারো চিন্তায় সে হাবু ডাবু খাচ্ছে । প্রতিক্ষার প্রহর বড় কষ্টের, বড় যন্ত্রনার । প্র্রেমের এক মহানায়ক স্কুল ফাকি দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে তাজের পদধনির আশায়। স্বর্গীয় প্রেম তার আ্ধিনায় দাউ দাউ করে জ্বলছে । তার চঞ্চলতা বৃদ্ধি পেয়েছে । তার চঞ্চলতায় তার মা ঠিক পেয়ে গেল । নিশ্চয় তার ছেলে কোন সমস্যায় পড়েছে । ওর মা ওকে জিঞ্চেস করে বাবা তোমার কি হয়েছে ? কদিন ধরে দেখছি অস্থির হয়ে গেছ । কিছুই হয়নি বলে সে জানিয়ে দেয় । সে ভাবে, এত অল্প বয়সে প্রেমের গল্প মাকে কি বলা যায় ? ৪২০ এর সাহস হলো না । মা বলল, তাহলে স্কুলে যাচ্ছ না কেন ? সমস্যাটা আমাকে বলো । মনে মনে সে ভাবল, মায়ের বোনের মেয়ে হয়ত মা তার পক্ষ নেবেন । সে ভরসায়, মায়ের মিষ্টি কথায় সে মমোতাজের নাম বলা মাত্রই রেগে গেলেন । বললেন, এই বয়সে নিচের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে ? লেখাপড়া বাদ দিয়ে এই সব করা হচ্ছে ? যদি তোমার আব্বা ও দাদা শোনে তাহলে আর রেহাই নেই, তোমাকে এবং আমাকে বাড়ী ছাড়া করে ছাড়বে । লেখাপড়া করো, চাকরী করতে হবে, দেখতে পাচ্ছতো দিন দিন সংসারের অবস্থা কি হচ্ছে ? তোমাকে মানুষ হতে হবে । তোমার বাবাও প্রায় সময় অসুস্থ থাকে । সংসারের কোন কাজ করে না । পরিবারের সবার কথা শুনতে হয় আমাকে । তুমি মানুষ না হলে তোমার ছোট ভাই-বোনগুলিও মানুষ হবে না । বাবা, তোমার প্রতি আমার অনেক আশা-ভরসা । চাকুরী করো, তারপর সময় মতো আমি তোমার জন্য সুন্দরী বউ এনে দেব । তোমার ফুফুরা সবাই সুন্দরী সুতরাং তোমার জন্য আমি ঐ রকম বউ নিয়ে আসবো, যে শুধু আমার চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াবে । তুমি আজ থেকে রশীদ ও আমিনুলের সাথে মিশতে পারবে না । ওরা তোমাকে নষ্ট করে ফেলেছে । মনে মনে সে বলল, তার তো ফিরে আশার আর কোন পথ নেই । তার সারা শরীর জুড়ে যে অবস্থান করছে তাকে কেমনে ভূলে যাবে । প্রথম প্রেমে সে হোচট খেতে চায় না । পড়াশুনায় ও চলাফেরায় তার উপর মায়ের কঠিন নজরদারী শুরু হয়ে গেল । দিন দিন মমোতাজের প্রতি তার ভালবাসা গভীর হতে লাগল । সে মুর্হুতের মধ্যে পাল্টিয়ে যাচ্ছে । তার চালচলন সবার থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যাচ্ছে । শুধু পাওয়ার আশায় ওকে নিয়ে সারাক্ষণ স্বপ্নে বিভোর থাকে । কবে, কখন, কোথায় তার ভাললাগার কথাটা তাকে বলতে পারবে সেই পরিকল্পনা আকঁতে থাকে । মনের অজান্তে কখনো কখনো সেই বিখ্যাত গানের কলি মনে মনে বিড় বিড় করে গাইতে থাকে জ্ঞচন্দনা পাল্দে শুয়ে - একা একা কি হবে- জীবনে তোমায় যদি পেলাম নাজ্ঞ । ভাবতে ভাবতে তার জন্য সে এক বুকভরা ভালবাসা জমা করে রেখেছে । এতদিনে হ্নদয়ের মাঝে সে বিশাল তাজমহল গড়েছে । একটি মেয়ের জন্য পুরুষের হুদয়ে এমন গভীর ভালবাসা হয় জীবনের সেই ক্ষণে সে বুঝেছিল । তাজকে তার ভালবাসার কথা বলা হয়নি তারপরও সে নিজের অজান্তেই মাঝে মধ্যে মনে করতো জ্ঞজ্ঞহায়রে প্রেম, তোমার পবিত্র শিখা চিরকাল জ্বলে - মহারাজপুর হতে আসে প্রেম - সাতক্ষীরাতে যায় চলেঞ্চঞ্চ । সে মনের অজান্তে এক সময় তাকে ডেকে বলে তাজ, তুমি জানো না, মনের অজান্তে তোমাকে কত ভালবেসে ফেলেছি । এখন আমার জীবনে, মরণে, শয়নে, স্বপনে, দিবা, নিশি চারদিকে শুধু তোমারই প্রতিচ্ছবি । সে অজানা, অচেনা এক পথের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। জ্ঞ সে স্বপ্ন দেখে নীড়ের পাখি আসছে নীড়ে, অনেক পাহাড়, মাঠ পেরিয়ে ভালবাসা ঠোটে করে জ্ঞ । তার স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়, তবুও সে স্বপ্নে দেখে । সারাক্ষণ একটাই চিন্তা, একটাই ভাবনা, কখন আসবে সেই ক্ষণ, যখন তাজকে জড়িয়ে ধরে সে বলবে, লক্ষী মেয়ে এতদিন কেন আসোনি ? তোমার কি একটি বারও আমার কথা মনে হয়নি ? তুমি এতটাই নিষ্ঠুর, ইত্যাদি আরও অনেক কথা । তার দিন ফুরোয় তো রাত ফুরোয় না, আবার রাত ফুরোয় তো দিন ফুরোয় না, এই অবস্থা । কিন্তু চির সত্য এই যে, স্বপ্ন খুব কমই বাস্তবে রুপান্তরিত হয় । এখন মাঝ রাতে প্রায় তার ঘুম ভেঙে যায় । বুকের মধ্যে কষ্টটা ঢোলের বাদ্যর মত বেজে উঠে । লেপের মধ্যে শীতের আমেজ । মাথা ঢাকা, নিঃশ্বাস জোরে উঠা নামা করছে । এপাশ ওপাশ করছে । গলায় সুর নেই তবুও মনের অজান্তে সেই গানের কলি জ্ঞ পাথর কালো রাত, তারার বাগান শুন্য, পৃথিবীটা ঘুমালেও জেগে থাকে যদি কেউ, সে আমি, জ্ঞজীবনঞ্চ শুধু তোমার জন্যজ্ঞ । জ্ঞজীবনজ্ঞ তার ছদ্মনাম । সে ওকে নিয়ে যত ভাবতে থাকে ততই সে তার প্রতি নার্ভাস হয়ে যেতে থাকে । সে ভাবে, রাতের আধারে যা করা সহজ, দিনের আলোতে তা বলা কঠিন । এসত্য উপলব্ধি করে সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সামনে দাড়িয়ে ভালবাসার কথা গুছিয়ে বলা তার মত দুর্বল চিত্তের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । সে এই বিষয়টি পাঁকা করে ওদেরকে বলল, তার দ্বারা তাজ এর সামনে যেয়ে ভালবাসার কথা বলা সম্ভব নয় । খালেদা তাকে সাহস দিয়ে বলল, তার এ বিষয়ে কোন চিন্তা করা লাগবে না । তারপরও সে সাহস পায় না । সে ওদেরকে অনুরোধ করে বলল, না হয় সে একটা চিঠি লিখে দেবে । চিঠিটা তাজকে দিয়ে, তারা যেন তাকে বুঝিয়ে বলে । রশিদ, জ্ঞজীবনঞ্চ এর কথায় কাটা চামচ মেরে বললো, এই বুদ্ধিটা সবচেয়ে ভাল হবে । রশীদ তার পক্ষে বললেও জ্ঞজীবনঞ্চ ভাবতে থাকে কেননা, তার জীবনে সে কখনো চিঠি লেখেনি । কাকে কোন ভাষায় সম্বোধন করে লিখতে হয় তাও তার জানা নেই । পরের রাত্রে সারা রাত সে চিঠি লেখার চেষ্টা করেছে, কিন্ত কি দিয়ে শুরু করবে, কি লিখবে, সেই বিষয়গুলি তার মাথায় আনতে পারেনি । একবার ক্লাশ পরীক্ষায় প্রধান শিক্ষকের নিকট চিঠি লিখতে এসেছিল তাই তার সন্দেহ হয়েছিল, চিঠির শুরুটা জনাব না হলেও, বরাবর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেও হতে পারে।






এগার

মাদ্রাসায় তার উপরের ক্লাশের একটি ছেলে জ্ঞজীবনঞ্চ কে খুব সেনহ করে । কিন্ত জ্ঞজীবনঞ্চ তাকে প্রায় সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত। বিপদে পড়ে সে তার দারগ্রস্ত হয় । হাতে সময়ও খুব একটা নেই । তাই একদিন সে তাকে বলল, তার এক বন্ধু প্রেমে পড়েছে । তাকে চিঠি লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অথচ সে প্রেমের চিঠিতো লিখতে জানেনা । তাই সে যদি একটা চিঠি লিখে দেয়, তাহলে তার সম্মানটা বাঁচে । কথামতো পরেরদিন সে তাকে একটা চিঠি লিখে দেয় । চিঠিটা পড়ে সে নিজেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে । সে অবাক হয়ে যায় । মানুষ এত সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারে ? অথচ, সে কি সব হিজিবিজি লিখে সময় নষ্ট করেছে । প্রেমিকার কাছে চিঠি লেখার ষ্টাইলটা অন্য রকম । সে তার ভূল বুঝতে পেরে একা একা খুব হেসেছে । ভাগ্যিস কেউ তার লেখা চিঠিটি দেখেনি । প্রেমিকার কাছে জনাব, বরাবর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে লেখা দেখলে তাকে সারাজীবন অপবাদ শুনে যেতে হতো । আর যারা পড়তো তাদের পেটের চামড়া খিল ধরে যেত । মানির মান আল্লাহ রাখে। সে মনে মনে বলল, তার কাছে তার চিঠি লেখার কোর্সটা করতে হবে । তার চিঠির ভাষাগুলো এতই ছান্দিক ও কাব্যিক যে, যে কোন মেয়ে পড়লেই শেষ । প্রেম না করে আর যাবে কোথায় । একটা লাইন পড়ে আর একটা লাইন পড়ার আগ্রহ থেকে যায় । দুই পৃষ্টার এই চিঠিতে ভাষার কোথাও ছন্দ পতন ঘটেনি । সুক্ষ্ম নিপুণ হাতের ছোয়া । মনে হলো এ বিষয়ে তার অভিঞ্চতা অনেকদিনের । বন্ধুকে ধন্যবাদ না দিয়ে সে পারল না । চিঠিটা একান্তে গোপনে বসে সে নিজে যে কতবার পড়েছে তার শেষ নেই । বৈঠকঘরে তার পড়ার জায়গা এবং রাতে সে ওখানেই ঘুমায় । ভূতের ভয়ে হারিকেন ধরিয়ে রাখে সারা রাত্র । অন্যরা ঘুমিয়ে পড়লে সে ঐ চিঠিটার অনুরুপ আরেকটা চিঠি লিখে ফেলে । হাতের লেখার জন্য সবার কাছে সে প্রশংসা পেত । পরের দিন সে রশিদ ও আমিনুলকে চিঠিটা দেখাল । ওরা দেখে বিশ্বাস করতে চাইল না যে, ঐ চিঠি তার মত নাদানের দ্বারা লেখা সম্ভব । আমিনুল তো বলেই ফেলল, নাকের পোটা এখনো ঝুলে থাকে যার সেই লিখবে এই মহাকাব্য । সে বলল, তোদের হিংসা হচ্ছে তাই বাজে কথা বলছিস । যাইহোক এক পর্যায়ে ওদের কাছে সে সত্য কথা স্বীকার করতে বাধ্য হল । সেদিনই সে বাজার থেকে বাই এয়ার মেইল লেখা একটি ইনভেলাপ কিনে আনল এবং সেটা সুন্দর ভাবে গাম দিয়ে এটে খালেদার কাছে জমা রাখলো । এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, ইতিমধ্যে খালেদা দুজনের সাথে প্রেম করেছে অর্থাৎ তার খালা আবার এই বিষয়ে মোটামুটি পরিপক্ক । আর করবেই না বা কেন ? তারতো কোন দোষ নেই । সুন্দর চেহারার অধিকারী, যে দেখে সেই পছন্দ করে । যাইহোক, খাম যে ভাবেই এটে দেয়া হোক না কেন তার খালা ওটা অবশ্য খুলবে এ ধারনা তাদের ভিতরে বদ্ধমুল ছিল এবং পরবর্তীতে সেটাই ঠিক হয়েছিল । বিশেষ মারফত সে জানতে পারল মহানায়কের জীবন সংগীনির পদধুলি আর দুদিন পরেই পড়বে । এই আসায় সে প্রহর গুনছে । তার আসার একদিন আগে সে তার খালাকে বলল, চিঠিটা একুট দাও আরও কিছু লিখে দেই । খালা বলল, আমি উঠিয়ে রেখেছি । আর কি দরকার ? কালতো সে আসবেই, কোন সমস্যা নেই । তুমি চিন্তা করো না । সে বিশেষ পিড়াপিড়িতে তার খালা বলল, চিঠিতে কোথাও ভুল নেই । খুব সুন্দর লেখা হয়েছে, তাজ পড়লে একেবারে পাগল হয়ে যাবে । সে অবাক হয়ে বলল, তাহলে তুমি . ...। তার খালা আমতা আমতা করে বলল, না মানে, না মানে দেখলাম, কোথাও কোন ভুল আছে কিনা ? মনে মনে সে বলল, বেশ করেছো, তুমিইতো উপযুক্ত খালা । জোরে বলতে সাহস হলো না, কেননা তার নাকে রশি বাধা । তারই হাতে তার প্রেমের পেয়ালা অপেক্ষা করছে । সে মনে মনে বলল, আর যাই হোক না কেন, ভাগ্নের প্রেমিকার চিঠি খালা দেখে ফেলেছে। একটু লজ্জাও সে অনুভব করলো । পরক্ষনেই সে তার খালার সাথে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করেছে । আর সে সময় সে উপলব্ধি করেছে মানুষ প্রেমে পড়লে কবি এবং সাহসী হয়ে উঠে, লাজ শরম বলে তার কিছু অবশিষ্ট থাকে না । প্রেম এমন একটি ঐশ্বরিক দান যা মানুষকে কখন আক্রান্ত করে সে তা বুঝে উঠার আগেই তাকে পেয়ে বসে । প্রেম আছে বলেই পৃথিবীটা এত বৈচিত্রময় । প্রেমে পড়লে মানুষ স্বভাব সুলভ ভাবে ভদ্র হয়, তার কাছে পৃথিবীর সব কিছু সুন্দর লাগে । গুছিয়ে কথা বলতে শেখে। কথার আর্ট বা বাচন ভংগি পাল্টে যায় । যাইহোক, সব প্রতিক্ষার প্রহর গুনে শেষ প্রান্তে এসে পরেরদিন সন্ধ্যায় সে জানতে পারল তার প্রানের একমাত্র প্রেয়সী, প্রিয় রাজকন্যার পদধুলি পড়েছে । সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় । আনন্দে বিভোর হয়ে সে পৃথিবীর সবকিছু জয় করার এক দুরন্ত বাসনায় উদ্বেলিত হয় । আগামী কাল সকালে তার সাথে দেখা হবে এক মিষ্টি মুখের । ভাবল, একটা শুভ্র বেলী ফুলের মালা তার হাতে দিয়ে সে চুপ করে দাড়িয়ে থাকবে । সন্ধ্যায় হারিকেন নিয়ে বই পড়তে বসলেও তার পড়ায় আর মন বসল না । আনন্দে দুরন্ত ঘুঘুর মত উড়তে চায় তার এই অবুঝ মনটা । প্রিয়ার আগমনে পৃথিবীর সব ভালো লাগা তার উপর এসে ভর করলো । মনের অজান্তে কল্পনার চাদর ঠেলে সে মুক্ত বিহংগের মত মেঘের সাথে ভেসে চলছে । কত স্বপ্ন, কত আশার বানী, কত কথা বলার আছে তাকে । প্রথমে কে কথা বলবে ? সে বা তাকে মেনে নিবে কিনা ? তাকে ভালবাসে কিনা ? ভালবাসাটা মনের ব্যাপার । জোর করে দেশ জয় করা গেলেও মনের উপর কারোর জোর খাটে না । এটৗ সম্পুর্ন তার নিজস্ব ব্যাপার । জীবনের প্রথম জয় পরাজয় নির্ভর করছে তারই কাছে । হঠাৎ তার মায়ের ডাকে সে সম্বিৎ ফিরে পেল । ক্ষিদে নেই বলে তার মাকে জানিয়ে দিল । এমন দিনে কি রাজ্য জয় করা রাজার ক্ষিদে লাগে ? বিজয়ের উল্লাস । তবুও মায়ের আপত্তি, না, রাতে উপোষ করা যাবে না । তাতে স্বাস্থ্য খারাপ হবে, মাথা ঘুরবে, পড়াশুনায় মন বসবে না । মনে মনে সে বলল আজ রাতে তোমার ছেলের আর মন বসবে না। তোমার গুনধর ছেলের মহারানী হাজির । কিন্ত না, শেষমেশ অগ্যতা মায়ের আদেশের হুকুম প্রতিপালিত হলো । তড়িঘড়ি করে দুমুঠো খেয়ে সে শুয়ে পড়ল । কল্পনার ফানুষ উড়িয়ে সে ভাবছে। লাইলী মজনু কে কাকে কতটুুকু ভাল বেসেছিল তা আজ তার আর জানার প্রয়োজন নেই । তারা তাদের মত করে ভালবেসে ছিল । আর সে তাকে তার মত করে সব সত্তাকে উজাড় করে, তার বিশ্বাস দিয়ে তার প্রিয়াকে ভালবেসেছে । সে তাকে ভালবেসেছে রংধনুর সাতটি রংয়ের সমাহারে । জীবনের প্রথম ভালবাসা, এখানে বাহ্যিক কোন চাওয়া পাওয়া নেই । হ্নদয়ের আকুতি । মনের বাধ ভাঙা স্রোত । শুধু কোন নারীর ভালবাসা পাওয়া, যা হ্নদয়ের মিত্রতা । তার আবার মনে হলো সে যা ভাবছে তার বিপরীত কিছুতো হতেও পারে । হয়ত সে যদি ওর উল্টো টা করে ফেলে তাহলে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে । তাদের সংসারে নিরব অভাব চলছে । এটৗ সে জানে, সংসারে এত অভাব জেনেও কোন মেয়ে কি স্বইচ্ছায় তাকে ভালবাসতে চাইবে ? সে রাতে সে তার নিজের প্রশ্নের জবাব খুজে পায়নি । তবুও তার ভাবতে ভাল লাগছে । কল্পনার ভিতর অন্য রকম আনন্দ । সে তারই ভিতর বেঁচে থাকার সাহস পাচ্ছিল । যখন তাকে নিয়ে সে রাজ্যের এতসব ভাবছে, ঠিক তখনই তার মনে হলো তার খালেদা খালা এতক্ষনে তার চিঠিটা হস্তান্তর করেছে এবং সেও তাকে নিয়ে ভাবছে । রাত অনেক হয়েছে মাঝে মাঝে মোরগ ডেকে জানিয়ে দিচ্ছে রাতের প্রহর । পৃথিবীর সকল প্রানী ঘুমালেও তার চোখে আজ ঘুম নেই । হালকা শীত, কাঁথা মুড়ি দিয়ে সে আবার বেশীক্ষণ থাকতে পারে না । তার পাশের খাটে যে লোকটি শোয়া ছিল সে জোরে জোরে নাক ডাকাচ্ছিল । হঠাৎ তার দুষ্টমীর খেয়াল হলো, যেমন চিন্তা তেমন এ্যাকশন । দিল তার নাকের উপর পানি ঢেলে । চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল । তার দাদার ঘুম ভেংগে গেল । দোতলা থেকে ডেকে জিঞ্চেস করলো, এত রাতে বৈঠকঘরে কি হয়েছে ? সবাই নিরব, কেউ কথা বলছে না । ওর দাদী বলল, হয়ত মনসুর স্বপ্ন দেখে চিৎকার দিয়েছে । মনসুর বলল, স্বপ্ন দেখেছি না ছাই । তবে কি ? কি আর বলব, তোমাদের এই বদমায়েশটৗ নাকের উপর পানি ঢেলে দিয়েছে । ওর দাদা, দাদীকে ডেকে বলল ওর কি বুদ্ধি শুদ্ধি হবে না ? আর কত বড় হলে ওর বুঝ শক্তি আসবে ? এই শীতের রাতে কারোর গায়ে পানি দেয় ? সে চেচিয়ে বলল, জোরে জোরে নাক ডাকালে কি কারোর ঘুম হয় ? এতটা রাত হয়েছে তার নাক ডাকানোর জন্য এখনো ঘুমাতে পারিনি । ওর দাদা বলল, তাই বলে কি তুই শীতের রাতে মানুষের গায়ে পানি ঢেলে দিবি ? তোর মজা দেখাব কাল সকালে । ওর দাদার খুব রাগ, তাই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল । কখন যে কি করে ফেলে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। মনে মনে সে ভাবল তার এই কাজটা করা ঠিক হয়নি । কেউ যদি তাকে এমন করত অবশ্য তারও কষ্ট হতো । তাই সে অনুতপ্ত হয়ে তাকে আস্তে আস্তে বলল মনসুর ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে । সকালে তুই দাদাকে বলিস তেমন কিছু হয়নি । সে ওকে বুদ্ধি শিখিয়ে দেয় , বলবি একফোটৗ পানি দিয়েছিল, আমরা মিমাংসা করে নিয়েছি । ঘুমিয়ে ছিলাম তাই বুঝতে পারিনি । মনসুর সুযোগ বুঝে তাকে বলল, সকালে এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি কিনে দিস, আমি নানাকে ম্যানেজ করে নেব, ধমকের সুরে বলল, এখন ঘুমা, জ্বালাসনে তো । সে তার কথায় রাজী হয়ে সে বারের মত বেঁচে গেল । মনসুরের আশ্বাসে মনটা কিছুটা আবার ভাল হলো তার । কিন্ত এখনও সকাল হতে ঘন্টা খানেক বাকি । এক অন্যরকম অনুভূতিতে ঘুম আসছে না তার । সকালে তাজ এর সাথে দেখা হলে হয়ত সে বাক শক্তি হারিয়ে ফেলবে । তার সামনে দাড়িয়ে সে কথা বলতে পারবে না। তাজ হয়ত মুখ খুলে বলবে, আমারও অনেক দিনের ইচ্ছে কিন্ত কোনদিন সাহস পাইনি যদি তুমি ফিরিয়ে দাও । এসব আবোল তাবোল চিন্তায় কখন যে ভোর হয়েছে সে ঠিক পায়নি । হয়তবা তার প্রিয়ার আগমনে রাত অনেক আগেই শেষ হয়েছে । তার কাছে সকালবেলা টৗ কেমন কেমন লাগছে । যেন চারিদিকে সাজ সাজ রব । হয়ত তার প্রিয়ার আগমনে উল্লসিত তরু পল্লবের কুঞ্জবন, চারিদিকে ভ্রমরের গুঞ্জরণ, আর কোকিলের কুহুতানে মুখরিত আজ । দক্ষিনা প্রভঞ্জনের মৃদ হিল্লোলে, পাখীর কল কাকলীতে কর্ম চঞ্চল কয়রার পল্লী প্রকৃতি । গন্ধে গ্রামে, নগরে, বিজনে চৈতালী হাওয়ায় মৃদ আলাপন । আম্রকাননে কচি কিশলয়ের প্রান চাঞ্চল্য । কুসুুম শোভিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ সুন্দরবনের অপার মহিমায় কয়রার জনপদে প্রানের সমারোহ । সুুরভিত ফুলে ফলে ভরপুর কয়রার কানন গিরি । তাকে বরণ করে নেয়ার আজ মহা আয়োজন । প্রেম চির সত্য, চির অমর । এ যেন তারই হাতছানি ।


বার

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তারই পবিত্র মুখের দর্শনে সকালে সে রওনা হয়ে গেল । আগেই বলেছি তাজ তার নানার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছে । রশীদদের বাড়ীর সামনে যেতেই জ্ঞজীবনঞ্চ দেখতে পায় ওরা চারজন দাড়িয়ে গল্প করছে । সে তাদের কাছে যেতেই সবাই মুখ ভার করে রাখে । সে কোন কথা বলল না । অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভংগ করে তাজ তাকে উদ্দেশ্য করে রাগতঃ স্বরে বলল তোমাকে আমি প্রেম করা শেখাবো । এই চিঠি আমি খালাকে দেখাবো । তার কথায় সে হতবিম্ব হয়ে পড়ে । জড় পদার্থের মত সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকে। ডানা ভাঙা আহত পাখীর মত সে ভেঙে পড়ল । মুখ ভাড়ের মত অন্ধকার করে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়ে থাকল । হয়ত এখনই তার পৃথিবী চারিদিকে অন্ধকার করে সব কিছু নস্যাৎ করে দেবে । সে কি ভেবেছে আর এখন কি হতে যাচ্ছে । এমনটি ঘটবে সে কখনো কল্পনাও করেনি । সে এতদিনে তিল তিল করে তাকে তার হ্নদয় সিংহাসনে স্থান দিয়েছে । সেই বিশাল হ্নদয়ের মাঝে পৃথিবীর আর কেউ থাকার যোগ্য নয় । সে যদি এখন বলে ভালবাসা শিক্ষা দেবে, তাহলে সে কাকে নিয়ে বাঁচবে ? প্রথম ভালবাসা এভাবে বিলীন হয়ে যাবে তা যেন মনকে মানাতে পারছে না । সে অসম্ভব ভাবে ভেংগে পড়ল । খালেদা তার চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকে মিথ্যা সান্তনা দেয়ার চেষ্টৗ করল । এক ফাঁকে সে দেখল তার অবস্থা লুকিয়ে তাজও দেখছে। আর জ্ঞজীবনঞ্চ! অসহায়ের মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর নিষপাপ মুখটির দিকে । বে-শরমের মত সে কিছুতেই ওর মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না । কালো দুটি টানা চোখ, শুদ্ধ গোলাপী দুটো ঠোট, মসৃন তুলতুলে গাল, মুখাবয়ব জুড়ে একটা মায়া মায়া ভাব। কি সুন্দর নয়নকাড়া চেহারা, মাথায় কোকড়ানো চুল, পেশিবহুল শারিরীক গড়ন, কত অসাধারণ সমন্বয় তার মধ্যে। তার এমন দেখার মধ্যে, সে শুধু তারই প্রিয়া হবার যোগ্য। অবশ্য যারা তাজকে দেখেছে তারা হয়ত এ বর্ননা বেশী বলে আখ্যায়িত করবে । কিন্ত তাজকে তো আর সবাই তার মত করে দেখবে না । প্রিয়জনকে দেখার জন্য সে রকম চোখ থাকতে হবে। সে তাজকে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তখনই তার খালেদা খালা তাকে থামিয়ে বলল, এখন এ বিষয়ে থাক, তুমি মন খারাপ করো না । আমরা সবাই বসে পরে একটা সিদ্ধান্ত্ত নেব । সে বাক শক্তি হারিয়ে ফেলল । মনে মনে বলল, সিদ্ধান্ত যাই নাও না কেন, তাজকে তার চাই । পিছনে ফিরে আসা তার পক্ষে আর সম্ভব নয় । এতদিনে তোমাদের উৎসাহে সে তার মন উজাড় করে তাকে ভালবেসেছে । জীবনের চরম সত্যকে হারিয়ে ফেলেছে সে তারই মাঝে । তাকে নিয়ে প্রেমের মহান মসজিদ নির্মান করেছে তার হ্নদয় মন্দিরে । যার মাঝে রয়েছে তার অসীম শ্রদ্ধা, অকৃত্রিম ভালবাসা, আর অফুরন্ত ত্যাগ । কিছুক্ষণ পর সেখান হতে খালেদা ও তাজ চলে গেল । তার চলে যাওয়াটৗ অনেকক্ষণ সে তাকিয়ে দেখল । গায়ের রং শ্যামলা বর্ণের হলেও দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে । হাটার মধ্যেও একটা আর্ট আছে । মাথার কোকড়ানো চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে । সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । এক সময় রশীদ নিরবতা ভংগ করে বলে, চল আমরা বাগানে গাব গাছের নিচে গিয়ে বসি । ওখানে সব কথা হবে । সে তাজ এর এমন কথায় ব্যাথা পেয়ে মনের অজান্তে কেঁদে ফেলে । আমিনুল একটা মিচকি শয়তান, তার কান্না দেখে সে জ্ঞজীবনঞ্চ এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয় । রাগে, অভিমানে সে তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে চেয়েছিল । ঐ শালার জন্য তো আজ তার এত কষ্ট । তার কাছে নিজকে খুব ছোট মনে হতে লাগল । জীবনের শুরুতেই তার জীবনটা এভাবে কোন নারীর কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে ? তার অস্থীরতা আরও বেড়ে গেল । কিছুতেই সে স্বস্তি পাচ্ছিল না । কিছুক্ষণ পর খালেদার সাথে সে আসল রশীদদের বাগানে । যেখানে তারা তিনজন বসা ছিল । জীবন নিরব হয়ে মুখ নিচু করে বসে আছে । ওরা চারজনে অনেক কথা বলল । তাজকে অনেক বুঝাবার চেষ্টা করে, অনেক যুক্তি তর্ক খাড়া করল কিন্ত সে কোন কথা শুনতে চাইলো না । তাজ এর দাম্ভিকতায় জীবনের মুখ দিয়ে আর একটি বারও কথা বের হলো না । একদিকে প্রেম হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়, অন্যদিকে তার মাকে সে নালিশ করার ভয় দেখিয়েছে । ভালবাসা তাকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল । সে অসাড় পাথরের মত নিশ্চুপ হয়ে, অবাক চোখে বসে বসে অঝোরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে । তাজকে শুনিয়ে শুনিয়ে রশিদ কে সে বলেছিল - সে আমার জীবনের শুকনো মরুভুমিতে এসে ছিলো এক পশলা বৃষ্টির মত । তাকে জীবন সংগীনি ভেবে আমার জীবনে এসেছিল অফুরন্ত সজীবতা । তাকে নিয়ে ভালোবাসার সীমাহীন একটা আকাশ গড়তে চেয়েছিলাম । সে একথা শুনার পর আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলো । বলল, এটা কখনো সম্ভব নয় । কেননা আমার পরিবার থেকে কখনো মেনে নেবে না । তাজ আরও যুক্তি খাড়া করলো, এখনো কেউ এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি । তাছাড়া আমরা দুজনে প্রায় দুই আড়াই বছরের ছোট বড় । বিয়ের এখনো অনেক বাকী । জীবন তাকে বলেছিল, তুমি বিয়ের কথা চিন্তা করছ কেন ? এখানে প্রেমটাই বড় । তোমাকে পাওয়ার জন্য আমাকে আর কত বড় হতে হবে ? আমি সে পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকব । সত্যিকারে তোমার প্রেম ভালবাসা না পেলে আমি বাঁচব না । প্রেমের জন্য কেউ বাদশা হয়েছে, আর আমি তোমার কাছে প্রেম ভিখারী । প্রেমের জন্য কেউ তৈরী করেছে তাজমহল, কেউ তৈরী করেছে অন্তরমহল আর তোমার জন্য আমি নির্মান করেছি প্রেমের মহান মসজিদ, যেখানে তোমার নামটি বার বার উচ্চারিত হচ্ছে । তোমার জন্য আমার বেঁচে থাকা । শুধু তুমি আমার পক্ষে থাকলে আমার বাহু ডোর হতে তোমাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না, এ সাহস আমার আছে। সে অবঞ্চা সুরে তাকে বলেছিল, তোমার জন্য আমি রজকিনী হতে পারবো না, তুমি প্রেমের কিছুই বোঝ না । সুতরাং এ বিষয়ে আর কথা বলো না । তোমার উপর আমার ভীষন রাগ হচ্ছে । জীবন আর কথা না বাড়িয়ে, তার এই অপমানের জন্য ব্যাথা ভরা হ্নদয় নিয়ে ওখান থেকে চলে আসে । সে এখন বড় একা হয়ে গেল । ব্যর্থ জীবনের কোন মুল্য নেই জেনে লেখাপড়ায় এবং কোন কাজে তার আর মন বসতে চাইছে না । সেদিনই সে বুঝে ছিল আসলে প্রেমে সুখ নেই, আছে শুধু জ্বালা আর কষ্টদায়ক বেদনা । তারপরও ভালবাসা বলে একটা কথা আছে । যার জীবনে প্রেম, ভালবাসা নেই সে কঠিন হ্নদয়ের মানুষ । সে মানুষ খুন করতেও ভয় পায় না । কিন্ত সে তাকে তার নিজের মত করে ভালবেসেছে । সে তার মানস প্রিয়া । তাকে তো আর ছোট করে দেখা যায় না । সে ভাল না বাসলেও কি হয়েছে, সেতো তাকে ভালবেসেছে । সে তার ভালবাসার ফুলকে তো আর কলংকিত করতে পারে না । তাকে এবং তার প্রেম কে তো আর ছোট করে দেখতে পারে না । কিন্ত তারপরও মনের কাছে সে হেরে গেল । মন টা ভীষন ছোট হয়ে গেল । নিজেকে তার কাছে বড় অপরাধী মনে হতে লাগল । মনকে সে সান্তনা দিতে চেষ্টা করল এই বলে যে, তার জীবনে এ আঘাত তো আর নতুন নয় । আর পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতাও সুন্দর, কারণ এটা আপন মানুষেরাই উপহার দেয় । এ সত্য উপলব্ধি করে সেদিন সে নিজেকে সামলিয়ে নিল । অর্থ ছাড়া তার আর কি নেই ? অর্থ দিয়ে তো আর প্রেমের মাপ কাঠি ওজন করা যায় না । এটা মনের ব্যপার, হ্নদয়ের স্পদন, মনের আকুতি, অকৃত্রিম ভালবাসা, স্বর্গীয় সুখ । মনের অজান্তে সে ভাবছে, তাজ তাকে এত অবহেলা করল কেন ? আগে তো সে কোনদিন তার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করেনি । হেসে খেলে কত রাত দিন তারা পার করেছে । নাকি সে অন্য কাউকে ভালবাসে ? না, আমি কি দেখতে এতই খারাপ যে, আমার সাথে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করছে ? তাজ, তুমি জানো না, আমি তোমার কাছে কি চাই ? তুমি যদি জানতে তাহলে আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারতে না । বিড়বিড় করতে করতে জ্ঞজীবনঞ্চ প্রতিঞ্চা করে, সে ভাল না বাসলেও এক তরফা ভাবে সে তাকে জীবনের শেষ মুর্হুত পর্যন্ত ভালবেসে যাবে । দুনিয়ার মানুষ জানবে জ্ঞজীবনঞ্চ এর জন্য শুধু তাজের জন্ম ।

তের

জ্ঞজীবনঞ্চ এর বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে প্রায় সকলেই প্রেমে হাবুু ডুবু খাচ্ছে । রশীদ, মিজান, সফি, আরো অনেকে । লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলে ওরা সবার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে হৈ চৈ করে বেড়ায় । রশীদ ভালবাসে কুসুমকে । নামে কুসুম কাজেও খুব মিষ্টি মেয়ে ছিল । সেই তখনকার সময়, যখন মেয়েদেরকে অনেক সর্তকতার সাথে চলতে হতো । সে সময় সে ছিল তাদের মধ্যে এক হাসি-খুশীর মেয়ে । চঞ্চল ঘুঘু পাখির মত ডানা মেলে সে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াত । সে ছিল তাদের মাঝে এক আত্মবিশ্বাসের প্রতিক । কে ছেলে আর কে মেয়ে তার কাছে কোন ভেদাভেদ ছিল না । সে সবাইকে এক নিমিষে আপন করে নিতে পারতো । প্রান চঞ্চলা এক কিশোরী । তাদের সাথে একেবারে খোলামেলা মিশতো । রশীদকে সে মন প্রান উজাড় করে ভালবাসতো । রশীদ ও তাকে আপন করে ভালবাসতো । অবশ্য রশীদের বাইরের দিকটৗ বন্ধু মহলে অনেকেই কেউ বুঝতে পারত না । সে অনেকটা চাপা ভাব নিয়ে চলাফেরা করত । তারপরও মাঝে মাঝে সে জ্ঞজীবনঞ্চ কে কিছু কিছু বলত । জ্ঞজীবনঞ্চ ছিল ওদের মাঝে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত । ওদের সংগে সংগ দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না তার । একবার স্কুলের বাৎসরিক স্পোর্টসে মেয়েদের চেয়ার সিটিং খেলায় সবার টার্গেট কুসুমকে ফাষ্ট করানো । পুর্ব পরিকল্পিতভাবে রশীদকে দেয়া হলো বেল বাজানোর দায়িত্ব । রশিদের চোখ বাধা । কিছুক্ষণ পর পর তার ইচ্ছেমত বেল বাজানো থেকে বিরত থাকবে । জ্ঞজীবনঞ্চ কে দায়িত্ব দেয়া হলো সংকেত দেয়ার কাজে । অর্থাৎ কুসুম যখন চেয়ারের সামনে আসবে তখন রশিদের পিঠে ছোট ইটের টুকরা মেরে সর্তক করা। সেদিন কুসুম এর ফাষ্ট হওয়ায় রশিদের আনন্দে যেন কুসুম ভেসে গিয়েছিল । সত্যিই, সে বয়সের সেই আনন্দের কথা আজও খুুব বেশী করে মনে পড়ে জ্ঞজীবনঞ্চ এর । ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় তার ফেলে আসা সেসব স্মৃতির অতল গহব্বরে । অনেকদিন পর তাকে মনে পড়ার কারণ হলো সেই হাসি খুশীর মেয়েটি আজ আর তাদের মাঝে নেই । রশীদ ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তাকে অন্য এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায় । সেখানে এক বছর ঘর সংসার করার পর ব্রেইন টিউমার হয়ে সেই হাসি খুশীর কুসুম চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় । ওরা আজও তাদের মাঝে তার শুন্যতা অনুভব করে । তার কথা খুব মনে হয় এবং দোয়া করে সে যেন জান্নাত বাসিনি হয় । অনেক মেয়েরা অর্থাৎ বন্ধুদের প্রেমিকারা মাঝে মাঝে জ্ঞজীবনঞ্চ কে বলতো, তুমিতো নিবেদিত প্রানের মানুষ । আমরা যখন যেটা বলি, সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাক, সবার উপকার কর অথচ তুুমি কোন প্রেম ট্রেম করো না কেন ? বন্ধুরা বলতো আরে না, জ্ঞজীবনঞ্চ তো আমাদের চেয়ে অনেক সিনিয়র । তার মানে ? তার মানে, সে ব্যর্থ প্রেমিক। ওদের বান্ধবীরা বলতো ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে আর আমরা জানিনা । তবে এত দুরে প্রেম করলে কেন ? সব সময় কাছে থাকলে আর তোমাকে এভাবে ছ্যাকা দিতে পারতো না । এসব কথায় ওরা আনন্দ পেলেও সে মনে মনে কষ্ট পেত কিন্ত কখনো প্রকাশ করত না । যে প্রেম এক তরফা সেটাকে কি সত্যিকারের প্রেম বলা যাবে ? যেখানে আনন্দ নেই, অনুুরাগ, অভিমান নেই, সেটা প্রেম হতে পারে না । তাই একদিন লাইলী জ্ঞজীবনঞ্চ কে বলেছিল, তুমি নতুন করে প্রেম করো, তার এক বান্ধবীকে সে ম্যানেজ করে দেবে । তার এ কথায় জ্ঞজীবনঞ্চ খুব কষ্ট অনুভব করেছিল । বুক ফাঁটা কষ্টে প্রতিউত্তরে বলেছিল প্রেম তো আর ছেড়া কাঁথা নয়, যে একজন চাইলো আর ছিড়ে দিলাম । লাইলী তার কথায় অনেকক্ষণ হেসে বলেছিল, সত্যিই তুমি একটা ভাল মনের মানুষ । এতদিনে জানলাম, সত্যিকারে তাকে তুমি ভালবেসেছ । খালেদার সাথে তাদের স্কুলে লাইলী একদিন তাকে দেখেছে । লাবন্য চেহারা, কোকড়া চুল, জ্ঞজীবনঞ্চ এর পছন্দ আছে বটে বলে ভূয়সী প্রশংসা করে । তবে তাজ এর এমনটি করার কারণ কখনো সে খুজে দেখেছে কিনা জানতে চায় লাইলী । জ্ঞজীবনঞ্চ এর সোজা উত্তর, কারোর মনের উপর তো আর জোর খাটানো যায় না । কারোর ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা তার মোটেই পছন্দ না । সে তার জীবনের প্রথম ভালবাসা, তাকে ছাড়াতো সে আর কাউকে তার জীবনের সাথে একাকার করে কল্পনা করতে পারে না । ভাল না বাসাটা তার ব্যাপার কিন্ত সে তো তাকে ভালবেসেছে । তারই অপেক্ষায় আজও সে পথ চেয়ে বসে আছে । তাই সে লাইলীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় । তবে তার বিশ্ব্বাস যদি তার প্রেম সত্য হয় এবং তার চাওয়ার ভিতর যদি কোন গলদ না থাকে তবে অবশ্য সে একদিন তাকে তার কাছে একান্ত করে পাবে । এ বিশ্বাসটুুকু নিয়ে সে আজও বেঁচে আছে । লাইলী বললো, না সে কষ্ট দেয়ার জন্য একথা গুলি বলেনি, বরং সবাই এক এক জনকে নিয়ে আনন্দে, ফুর্তিতে মেতে আছে অথচ সেখানে তুমি একা কেমন জানি নিরব থাক, তাই প্রস্তাবটা দিলাম । তার এই কথার জন্য সে কষ্ট পেলে তাকে মাফ করার জন্যও বলে । লাইলী জ্ঞজীবনঞ্চ কে আশ্বাস দিয়ে বলে তাজ এবার আসলে সে অবশ্য তার হয়ে ওকালতি করবে । তার প্রেমের গভীরতা তাকে জানিয়ে দেবে । তার মত একটা ছেলেকে কষ্ট দেয়, সেটা তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবে । লাইলীর আশ্বাসে জ্ঞজীবনঞ্চ এর চোখ দুটো ছলছল করে ভিজে যায়। খানিকটা সামলে নিয়ে লাইলীকে সে বলেছিল, সে জীবনে কিছুই চায় না, শুধু তাজ কে চায় । তাকে না পেলে সে যে বাঁচবে না । সে তার জীবন, সে তার মরণ । সে যতই তাকে এড়িয়ে চলুক না কেন, সে ততই তার কাছে যাচ্ছে । তার এই রুঢ় ব্যবহারে সে যেন তাকে আরও বেশী করে ভালবাসছে । তার প্রতি তার ভালবাসাটা যেন আরও গভীর হচ্ছে। জ্ঞজীবনঞ্চ এর ভালবাসার ত্যাগের কথা শুনে লাইলী বলেছিল, জ্ঞজীবনঞ্চ তুমি তাজকে এতটৗ ভালবাসো তা সে আগে জানত না । সত্যিই তারও খুব কষ্ট হচ্ছে তারপরও লাইলী তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে থাকে । তার সাথে ওর আর কখনো কথা হয়েছে কিনা তাও জানতে চায় । জ্ঞজীবনঞ্চ জানায় ওর সাথে তার আর কখনো কথা হয়নি । তবে ওদের ঠিকানায় সে আরও দুটি চিঠি লিখেছিল বলে জানায়। পরে সে শুনেছে, চিঠি দুটি নাকি তার বাবার হাতে পড়েছিল আর এই জন্য তাকে খুব বকা ঝকা শুনতে হয়েছে । তার জন্য ওকে বকা শুনতে হয়েছে সেই কষ্টে সে আর কোন দিন চিঠি লেখেনি । তবে মনের টানে, ওকে এক নজর দেখার জন্য আত্মীয়তার বাড়ীতে বেড়াতে যাবার ভান করে সে কয়েকবার ওদের বাড়ীতে গিয়েছে । কিন্ত কোন দিন তার সাথে কথা হয়নি । অনেক পরিকল্পনা করে বাড়ী থেকে রওনা হলেও তার সামনে সে কখনো কথা বলতে পারতো না । সে একেবারে সাহস হারিয়ে ফেলত । অগত্যা দুএকদিন ঘুরে তাকে এক নজর দেখে আবার ব্যর্থ মনে ফিরে আসত । তবে দিন তারিখ সঠিকভাবে তার মনে না থাকলেও খুব সম্ভব তাজ এর বিয়ের ছয়/সাত মাস আগে শরৎকালের প্রথম দিকে রশীদ আর সে ওদের ওখানে গিয়েছিল । উদ্দেশ্য একটাই রথ দেখার সাথে কলা বেচার সর্ম্পক । বিকাল তিনটৗর দিকে ওরা ওদের বাড়ীতে পৌছে গেল । ওদের শান বাধানো পুকুর ঘাটে একটৗ শিউলী গাছ ছিল । সন্ধ্যায় হাত পা ধুয়ে গম্ভীর ভাব নিয়ে সে একাকী বসে ছিল শানের ঘাটে । রশীদ ভিতরে তাজ এর বাবার সংগে গল্প করতে ছিল । তার বাবাু রশীদের সর্র্ম্পকে দুলাভাই । চাঁদনী রাত ছিল । শিউলী ফুুলের সুবাস বইছে । গন্ধটা বেশ চমৎকার । তাই সে আনমনে রাজ্যের একরাশ ভাবনা মাথায় নিয়ে একা একা কি যেন বিড় বিড় করে আউড়িয়ে যাচ্ছিল । হঠাৎ সে দেখে তার থেকে বেশ দুরত্ব নিয়ে শানের উপরে গিয়ে তাজ বসল । সে অবাক হয়ে গেল । ভুল দেখছে কিনা তাই সে চোখ কচলিয়ে নিল । না, সে ঠিকই দেখেছে । তার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল । আর কেউ ছিল না শুধু ওরা দুজন । অনেকক্ষণ হলো কেউ কোন কথা বলছে না । জ্ঞজীবনঞ্চ অপেক্ষা করতে ছিল সে আগে থেকে কিছু বলুক, কেননা সেতো তারই জন্য বার বার এত পথ কষ্ট করে এখানে আসে । আর হয়তবা সেও অপেক্ষা করতে ছিল জ্ঞজীবনঞ্চ আগে থেকে কিছু একটা বলুক । এমনি দোদুল্যমান অবস্থায় তারা আধা ঘন্টার মত নিরব ভাবে পুকুরের ঘাটে সেদিন বসে ছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ সাহস করে যখন কথা বলতে চেয়েছিল ঠিক সেই মুর্হুতে তার বাবার ডাকে সে চলে যায় । সেদিন তার এভাবে পাশে বসাকে সে ইতিবাচক ধরে নিয়ে ছিল । মনে মনে নিজকে খুশী বোধ করতে ছিল । তার কাছে মনে হচ্ছিল সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মধ্যে একজন । চিৎকার করে পৃথিবীর মানুষকে সে জানিয়ে দিতে চেয়েছিল, তার প্রেম মিথ্যা হতে পারে না । সে আজ যুদ্ধ বিজয়ী এক গর্বিত সৈনিক । ঐদিন রাতে তারা অনেকে ওদের বাড়ীর উঠানে খালী আকাশের নীচে ঘুমিয়ে ছিল । খুব ভোরে টয়লেটে যাবার জন্য জীবন বদনা খুজতে ছিল তখন সে রান্নাঘর থেকে একটা বদনা এগিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিল তোমাদের শোয়া কারোর ভাল না । তার মুখ থেকে এ কথা শোনার পর সে ভীষন লজ্জা পায়, কেননা সে জানে তার কাপড় রাতে ঠিক থাকে না । তার মুখের মুক্তা মিশ্রিত মিষ্টি হাসি দেখে সে আনন্দে ফেঁটে যেত চাইলো । চিৎকার করে পৃথিবীর সকলকে জানিয়ে দিতে চাইলো যে, তাজ শুধু তারই । তার চাওয়ার ভিতরে কোন পাপ ছিল না । মহান সৃষ্টিকর্তা তার মনোবাসনা পুর্ন করেছেন । সে যুদ্ধ বিজয়ী বীর । সে দেরী না করে রশীদকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার আনন্দের কথা গুলি এক নাগাড়ে বলেছিল। সীমাহীন আনন্দের মধ্যে সে ওদের বাড়ীতে আরও কিছুদিন থাকতে চেয়েছিল । তার প্রিয়তমা, এতদিন পর তার সাথে কথা বলেছে এবং তাও এক যাদুকরী ছন্দময় হাসিতে । সে এক মনোমুগ্ধকর যাদুকরী হাসি । কিন্ত উপায় নেই গোলাম হোসেনের । কেননা সে গত রাতে তার খালা কে বলে রেখেছিল সকালে চলে যাবে । সে মোতাবেক তার খালা সকালে উঠেই মুরগী জবাই করে দিয়েছে । তাই লাজ শরমের ভয়ে আর থাকার ইচ্ছাটা সে ব্যক্ত করতে পারেনি । অগত্যা সেদিনই তাদেরকে চলে আসতে হয়েছিল । আসার সময় তাদেরকে বিদায় দেয়ার জন্য তার বাবা মা গেটের বাইরে এসেছিল । জীবন ততক্ষনে মনে মনে তাকে খুজছিল, যে হয়ত সেও আসবে। কিন্ত তার বাবা মা থাকায় আসতে পারেনি । হঠাৎ জীবনের চোখ যায় তাদের ঘরের জানালায় । সে দেখতে পায় তার তাজ তাদের চলে যাওয়া এক পলকে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে । এমন দৃশ্য দেখে জীবনের ভেতরটা স্যাৎ করে উঠে । সে বার বার পিছন ফিরে দেখছিল । সেই হাসি, সেই দেখার স্মৃতি বুকে ধারণ করে জীবন বাড়ী ফিরে আসে । ওদের ওখান থেকে ফিরে আসার পর সে আরও ভেংগে পড়ে । লেখা পড়ায় তখন একেবারে তার মন বসাতে পারছিল না। তাকে নিয়ে বেশী বেশী ভাবতে গিয়ে একসময় সে যা লিখত তা যেন কবিতা হয়ে যেত । শুরু হলো জীবনের কবিতা লেখা । মিছে মিছে ভাবতে বা কল্পনার সাগরে ডুবে যেতে তার বেশ ভালই লাগত । মনে মনে ভাবত সে তাজ এর মুখোমুখি হবে এবং অতি শীঘ্রই তার মুখ থেকে শুনতে চায় সে তাকে সত্যিকারে কতটুকু ভালবাসে । তাজ এর ভালবাসা পাওয়ার অধীর আগ্রহে সে সময় গুনতে থাকে । এদিকে এস এস সি পরীক্ষার আর মাস তিনেক বাকী আছে । হাজার কষ্টের মাঝেও পরীক্ষার প্রস্ততি চলছে । একদিন হঠাৎ দুপুরের দিকে তার এক খালা তাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে জ্ঞজীবনঞ্চ কে তার নাম ধরে ডাকছিল । তার কানে শব্দটৗ ভেসে আসলেও সে গুরুত্ব না দিয়ে ভিতরে বসে পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিল । তখন তার খালা রাস্তায় জ্ঞজীবনঞ্চ এর চাচাতো ভাই রহিমকে পেয়ে বলল, সে যেন জ্ঞজীবনঞ্চ কে বলে তাজ এর গতকাল বিয়ে হয়ে গেছে । জ্ঞজীবনঞ্চ বৈঠকঘর থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে এক দৌড়ে বের হয়ে এসে তার খালাকে বলল, কি হয়েছে খালা ? তার খালা বলল, সে গতকাল তাজ দের বাড়ী হতে এসেছে । এক বিডিআর এর সাথে তাজ এর বিয়ে হয়ে গেছে । তাজ তোমাকে সংবাদটা বলার জন্য আমাকে বলে দিয়েছে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ে । তার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল । রহিম বুঝতে পেরে তাকে ধরে কোনমতে বৈঠকঘরের খাটের উপর এনে ফেলল । এখন জ্ঞজীবনঞ্চ এর পৃথিবী চারিদিকে অন্ধকার । বেঁচে থাকার এক বিন্দুও ইচ্ছে নেই তার । প্রমান করতে চায় সে তার ভালবাসার গভীরতা । সে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নেয় । সংসারে বাবা অসুস্থ, অসহায় মা ও চার ভাইবোন । কারোর প্রতি যেন আজ তার ভ্রুক্ষেপ নেই । নেই কোন পিছুটান । মনের অজান্তে শুধু অঝোরে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে । সে কবি সুকান্তের একজন ভক্ত । কবির কথাগুলো তার মনে ক্ষণে ক্ষণে বেঁজে উঠে । তাই সুকান্তের সেই দুরন্ত কথাগুলি জ্ঞযদি আর বাশী না বাজে, তোমরা আমায় ক্ষমা করো, ভূলে যেও । বিশ্বাস করো, আমি কবি হতে আসিনি, নেতা হতে আসিনি । আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম । যে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই নিরস পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম । শুধু মনে রেখ, পুর্নত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল - অপূর্নতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে তোমাদের মাঝে কেঁদে গেল ঞ্চ । ছোট একটৗ কাগজে এই অমিয় বানীটি লিখে সে তার বালিশের নীচে রেখে দেয় । হঠাৎ বাড়ীর ভিতর তার মা এবং দাদীর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখে তাদের ঘরের সামনে অনেক মানুষ জমা হয়েছে । সে ঘটনা জিঞ্চেস করার আগেই তার বাঁচা চাচী তাকে বলল, তুই কোথায় থাকিস ? তোর আব্বা এত অসুস্থ , তুই একটু খেয়াল রাখিস না । মারা গেলে তখন বুঝবি, কত ধানে কত চাল । এ কথাগুলো তার চাচী ক্ষোভের সাথে গড় গড় করে বলে যাচ্ছিল । অন্য একজন বলল, তোর আব্বা পেট ব্যাথায় ছটফট করছে এবং রক্ত বমি করছে । সে কয়েকজনকে ঠেলে ঘরের ভিতর উঠে দেখে তার বাবা উপুড় হয়ে পেটে হাত দিয়ে শুয়ে আছে । বিছানার উপর বমি এবং রক্ত পড়ে আছে । তার বাবার এ অবস্থা দেখে সে শিউরে উঠে । তার ছোট ভাই বোন গুলি পাশে বসে কাঁদছে । সে বড় হয়েও বাবার জন্য কিছু করতে না পেরে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে । তার বাবার এমন কষ্টে এবং ছোট ভাই বোনদের কান্না দেখে তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে হলো । সেদিন সে তার মায়ের শাড়ীর আচলে মুখ গুজে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল মা আমি বাঁচতে চাই । তার এমন কথায় তার মা বুঝে ফেলেছিল সে কি বলতে চাচ্ছে । কেননা তার মা তাজ এর বিয়ের সংবাদটা গতকালই পেয়েছিল । জীবনের মন খারাপ হয়ে যাবে, পড়ায় মন বসবে না এসব ভেবে ওর মা ঘটনাটা এড়িয়ে যায় । সেদিন শুধু তার মা তাকে বলেছিল আগে তোমার বাবা ও ভাইবোনদেরকে বাঁচাও। পরে আমি তোমার সব ইচ্ছে পুরন করব । সংসারে এত ঝামেলা তার উপর প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় সে দিন দিন পংগু হয়ে যেতে লাগল । তার কোন কাজে মন বসে না । তার মা মাঝে মাঝে পড়ার খোজ খবর তদারকি করত । অনেক রাতে তার মা পড়ার ঘরে এসে লুকিয়ে দেখত সে কি করছে । দেখত সে হারিকেন জ্বালিয়ে বই বুকের উপর রেখে ঘুমাচ্ছে । তার মা মনে করত হয়ত অনেক রাত জেগে পড়াশুনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই এখন ডাকার দরকার নেই । আসলে সে না পড়ে পড়ার ভান করে বই বুকের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে ভাবত তার ব্যর্থভরা জীবনের ইতিকথা । কেন এমনটা হলো ? সে কি তাজ এর জন্য এতই অযোগ্য যে, বিয়েটৗ হবার আগে তাকে একটি বারও জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না । সে তার দিকে তাকিয়ে একটি বারও বিয়েতে বাধা দেয়ার চেষ্টাও করল না । এসব ভাবনার কোল ছাড়িয়ে সে অসাড় পাথরে পরিনত হয় । সে জীবনে চরম আঘাত অনুভব করলো । নিজকে সে হেয় প্রতিপন্ন ভাবতে থাকে । ভাবতে থাকে যে জীবনে তাজ নেই অর্থাৎ প্রান নেই সেটা কোন জীবন হতে পারে না । সেখানে সুখ থাকতে পারে না । মরণ যেখানে বাসা বেধেছে সেই জীবনের কাছে সার্টিফিকেট এর কোন মুল্য থাকতে পারে না । সার্টিফিকেট দিয়ে কি হবে ? সে ভাবে ছাত্র হিসেবে সে তো কারোর চেয়ে কম বুঝে না । সবতো সে পারে, তাহলে তার মাথায় সার্টিফিকেটের চিন্তা কেন ? জীবনে যাকে ভালবেসে পেল না, তাহলে সে কার জন্য সুখী হবে ? নিজের জন্য তো সে কখনো ভাবে না । এরকম উল্টো পাল্টা চিন্তা ভাবনা সব সময় তাকে ঘিরে রাখতো । বন্ধুর মত পাশে এসে কেউ তাকে সাহস জোগায়নি । আত্মীয় স্বজন এবং পাড়ার অনেকে চেষ্টা করেছে যাতে সে নষ্ট হয়ে যায়, ধবংস হয়ে যায় । তাকে মানুষের মত মানুষ হতে হবে এমনটি ভরসা দিয়ে কেউ কোন দিন তার সাথে কথা বলেনি । তার খারাপ হওয়ার পিছনে অনেকে উৎসাহ দিলেও সে সব কিছুই বুঝত । জীবনের প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় তার সাহসী মনটা ভেংগে যায় । তাই সেও হারিয়ে যাওয়ার হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেয় । তারপরও পরিবারের মান সম্মানের দিকে তাকিয়ে তার একটা আত্ম বিশ্বাস ছিল যেমনি হোক সেও একদিন মানুষ হবে এবং লেখাপড়া শিখবে । পরিবারটা হলো একটা শক্ত গাছের শেকড়ের মত । এই শেকড়ের টান যে হ্নদয়ে অনুভব করবে সে কখনো কক্ষচ্যুত হতে পারে না । পরিবারের ছোট বড় সবার প্রতি তার হ্নদয়ের টান ছিল অন্যরকম । এই আত্ম প্রত্যয় টুকু সব সময় তার ভিতর কাজ করত । তার বাবার চিকিৎসার টাকা তার দাদাকে ম্যানেজ করতে হত । তাদের সংসারে কোন আয় ছিল না । তার দুই চাচা চাকুরী করলেও তার দাদাকে সাহায্য করার মত বেতন পেত না । কোনমতে নিজেদের পকেট খরচ এবং পারিবারিক সম্মান বাচানো । জমির ধান আর জমি বিএিুর টাকা দিয়ে তার দাদাকে সংসার চালাতে হত । এদিকে তার ফরম ফেলাপের সময় এসেছে । দাদার কাছে চাইতে তার সাহস হলো না । অগত্যা মায়ের কাছে হাত পাতা । কিন্ত মা কোথায় পাবে টাকা । তার মা ভীষন চিন্তায় পড়ে গেল । সে তার মায়ের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেও এখন তার কিছু করার নেই । ফরম ফেলাপ তো করতেই হবে আর এজন্য এক সপ্তাহের মধ্যে ৬০০ টাকা জোগাড় করতেই হবে । মা দিশা না পেয়ে তাদের এক পরম আত্মীয় অর্থাৎ আবেদ সাহেবের কাছে হাত পাতলেন । আবেদ সাহেব তার ছোট কাকুর সেই বন্ধুটি যার পরিচয় আগে দেয়া হলেও বর্তমানে সে আরও ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়েছে এবং যার জন্য সে তার নানাদের কাছে চক্ষুশুল হয়েছে । আবেদ সাহেব জ্ঞজীবনঞ্চ এর ফুফুকে বিয়ে করেছে । অবশ্যই আবেদ সাহেবের সাথে তার নানাদের বিরোধ তখনো মেটেনি এবং তাড়াতাড়ি মিমাংসা হওয়ার সম্ভবনাও কম । বিয়েটা হয়েছে একটা কাকতালয়ী ভাবে । তাদের বাড়ীতে সব সময় আসা যাওয়ার সুবাদে তার সালেহা বেগম অর্থাৎ জ্ঞজীবনঞ্চ এর চাচী একদিন রসিকতা করে আবেদ সাহেবকে বলেছিল তোমার কেইস মিটতে অনেক দেরী হবে তাই বলে কি বিয়ে না করে থাকবে ? তার চেয়ে তুমি মালিহাকে বিয়ে কর । সে তো অনেক সুন্দরী । আর সে সুবাদে আবেদ সাহেবের সাথে মালিহার একরকম সখ্যতাও হয়ে যায় । পরবর্তীতে সে মালিহাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালে জ্ঞজীবনঞ্চ এর দাদা ব্যতিত বাড়ীর সবাই রাজী থাকায় বিয়েটা হয়ে যায় । বিয়েটা হয়েছে বছর খানেক আগে । তাদের দাম্পত্য জীবন বেশ ভাল চলছিল । তারা সুখী দুটি মানুষ । জীবনদের পরিবারের সংষপর্শে এসে আবেদ সাহেবের মান সম্মান আগের চেয়ে আরও দ্বিগুন বেড়ে যায় । তার পুরানো ইতিহাস মানুষ ভুলে গেছে । চারিদিকে প্রশংসার জোয়ার। হঠাৎ করে জ্ঞজীবনঞ্চ একদিন মালিহা থেকে জানতে পারে আবেদ সাহেব তার পুরাতন ব্যবসায় ফিরে যাচ্ছে অর্থাৎ তার হাইজ্যাক করা খালাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে । অগ্যতা ওর সেজ নানী আবেদ সাহেবকে মেয়ে দেয়ার জন্য মতামত দিয়েছে সেই সুবাদে আবেদ সাহেব এখন ঘন ঘন বিয়ের জন্য ওখানে যাতায়াত করছে । জ্ঞজীবনঞ্চ তার খালার চেয়ে ফুফুকে বেশী ভাল বাসে । তাই বিয়ে ঠেকানোর জন্য সে একদিন তার সেজ নানীকে বলেছিল, যাকে মেয়ে দেবে না বলে পরগাছা বলে গালিগালাজ করেছ তাকে আবার মেয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ কেন? জ্ঞজীবনঞ্চ এর এমন প্রশ্নে তার সেজ নানী ভীষন রাগান্বিত হয়ে তার উপর চড়াও হয়ে বলে যেখানে আমি মেয়ে দেব না বলে এতকিছু করলাম সেখানে তোর ফুফুকে দিলে কেন ? সুতরাং তোর ফুফুর সুখের ঘরে আগুন দেয়ার জন্য এখন আমি মেয়ে দেব । যদি তোদের ক্ষমতা থাকে ঠেকাস । জ্ঞজীবনঞ্চ তার নানীকে পুরাতন কথা মনে করিয়ে দিতে আবার বললো, তুমি না বলেছিলে মেয়ের বদলে দশ হাত দেয়ালের উপর থেকে ........ জীবনের কথা শেষ করার আগেই ওর নানী ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় । ওর নানীর সোজা কাঠ খট্রা জবাব তখন বলেছিলাম এক কারনে আর এখন অন্য কারনে মেয়ে দেব । বিয়ে যাতে না হয় সে জন্য জ্ঞজীবনঞ্চ আবেদ সাহেবকে তার নানীর এই লম্বা গালিগুলি জানিয়েছিল । অবশ্য জ্ঞজীবনঞ্চ এর কথাগুলি সেদিন আবেদ সাহেবের কাছে ভাল লাগেনি । জ্ঞজীবনঞ্চ অন্য মারফত জেনে ছিল আবেদ সাহেব বিয়ে করবে না শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এমনটাই করছে । আবিদ সাহেব জয়গুন নাহারকে যে বিয়ে করবে এ ঘটনা সত্য নয় এসব কথা জ্ঞজীবনঞ্চ তার ফুফু মালিহাকে জানিয়েছিল । মালিহা জ্ঞজীবনঞ্চ এর যুক্তি মানতে নারাজ কেননা আবেদ সাহেব এখন প্রতিদিন রাতে জযগুন নাহারদের বাড়ীতে যায় এবং বর্তমানে মালিহার প্রতি খুব খারাপ আচরণ করছে । জ্ঞজীবনঞ্চ তার ফুফুকে বাঁচানোর তাগিদে এই বিয়ে ঠেকানোর জন্য আবেদ সাহেবের সাথে ঘোর বিরোধে জড়িয়ে যায় । সেই আবেদ সাহেবের কাছেই তার মা তার জন্য টাকা চেয়েছে । আবেদ সাহেব তাকে ২০০ টাকা দেয়ার আশ্বাস দিলেও জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মেছিল সে এ টাকা কখনো দেবে না । বর্ষাকাল চলছে । রাতে তার মা বলল, আবেদ সাহেবের কাছে টাকা চেয়েছি, ২০০ শত টাকা দিতে রাজী হয়েছে । যেয়ে নিয়ে এসো । ১৯৮৫ সাল । তখনকার দিনে রাস্তাঘাটে ইট বসে নাই । রাস্তায় হাটু পর্যন্ত কাঁদা থাকত । সে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো মেঘলা আকাশ । বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এবং ফিস ফিস করে বৃষ্টি হচ্ছে । ছাতার সিক একটা ভাংগা । আত্ম সম্মানের ভয়ে ভাংগা ছাতা নিতে তার সাহস হলো না তাই অগ্যতা ছাতা ছাড়া বৃষ্টির ভিতর সেই কাঁদা ঠেলে দুই আড়াই মাইল পথ হেটে গেল । আবেদ সাহেব তখনও ঘুমিয়ে । ঘুম থেকে ডেকে উঠানো হলো । তাকে দেখে বলল, এত সকালে কি মনে করে ? সে বলল, ফরম ফেলাপের জন্য মা নাকি টাকা চেয়েছিল ? আবেদ সাহেব চোখ কচলাতে কচলাতে জানিয়ে দিল আজকে হবে না । তাই সে যেন কাল সকালে আরেক বার আসে । অগত্যা মন খারাপ করে বাড়ী ফেরা । সে পরেরদিন আবেদ সাহেবের কথামতো কাঁদা ঠেলে আবার গন্তব্যে পৌছালো। কিন্ত ঐ একই কথা, টাকাটা তো তার কাছে নেই । তবে দেবদাসের কাছে কিছু টাকা পাবে, সেখান থেকে সে যেন ২০০ টাকা নিয়ে যায় । সে আশায় বুক বেঁধে আবারও এক মাইলের বেশী পথ হেটে দেবদাসের কাছে হাজির হয় । দেবদাসের সোজা উত্তর কেন যে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে তা বোধগম্য নয় । কেননা উনিতো আমার কাছে কোন টাকা পাবে না । এ কথা শুনে সে বিষন্ন মনে বাড়ী ফিরে আসে এবং তার মাকে সব ঘটনা খুলে বলে । তার মা তাকে আর একদিন যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয় । শুধু শুধু তার সময় নষ্ট হচ্ছে তাই সে আর যাবে না বলে তার মাকে জানিয়ে দেয় । তার মায়ের শেষ অনুরোধ আর একবার যাবার জন্য । দেখি যদি না দেয় তবে অন্য কারোর কাছ থেকে ধার নেব । তার মায়ের কথামত পরেরদিন আবারও সে আবেদ সাহেবের কাছে গিয়ে দেবদাসের টাকা না দেয়ার ঘটনা বললে উনি জ্ঞজীবনঞ্চএর প্রতি রেগে মেগে বলল দিতে চেয়েছি বলে প্রতিদিন আসতে হবে নাকি? এখন তার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই, যদি পারে তাহলে পরে ১০০ টাকা দিয়ে দেবে । একথা শোনার পর জীবন আর দেরী না করে তাকে মনে মনে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে । তার মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল । লেখা পড়া বাদ দিয়ে এত কাঁদার ভিতর প্রতিদিন কষ্ট করে গিয়ে যদি কাংখিত জিনিস না পাওয়া যায় তাহলে মনটা স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ হয়ে যাবার কথা । তেমনি তার কষ্টটা আরও দ্বিগুন হয়ে গেল । মন খারাপ করে সে বাড়ী এসে না খেয়ে স্কুলে চলে গেল । আর মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগল । বলল, আল্লাহ তুমি আমার ফরম ফেলাপের একটা ব্যবস্থা করে দাও । সামনে আর তিন দিন বাকী ফরম ফেলাপের শেষ তারিখ । কিছুতেই বুদ্ধি করে পারছে না যে, সে কি করবে । সারাদিন খাওয়া হয়নি, মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে সে দেখল নদীতে অনেকে জাল চেপে শোল মাছ ধরছে । বাড়ীর সামনে নদীতে কতকগুলি কমলি গাছ দেখে তারও কেন যেন মনে হলো এটার ভিতর হয়ত কিছু খাওয়ার মাছ পাওয়া যাবে । তাই সে বাড়ীতে বই খাতা রেখে তার ছোট ভাইটাকে নিয়ে প্রথমে জাল দিয়ে কমলি গাছগুলো ঘিরে ফেলে । তারপর ভিতরে যেয়ে কলমি গাছের গোড়ায় হাত দিতে তার ছোট ভাইটা একটা গলদা চিংড়ী ধরে । আরো গলদা চিংড়ী আছে ভেবে সে জাল সুন্দর করে গুজে দেয় এবং সত্যি সত্যি সেখান থেকে সে এবং তার ভাই ২০/২৫টি বড় গলদা চিংড়ী ধরে । ওর বাবা সংবাদ পেয়ে শেষের দিকে এসে ওদের দু ভাইকে কিছুটা সহযোগিতা করে । সেদিন সেই মাছ বাজারে ৮২৫ টাকা বিক্রি করে তার পরীক্ষার ফরমফেলাপের টাকা জোগাড় হয়েছিল । সেদিন সে বূঝে ছিল সত্যিকারে আল্লাহ মানুষকে এভাবে সাহায্য করে থাকে । আর সেদিন থেকে বিশ্বাস জন্মেছিল সর্বাস্থায় মানুষদেরকে আল্লাহর উপর ভরসা রাখা উচিত । সবকিছুর নিয়ন্তা একমাত্র আল্লাহ । ফরম ফেলাপের পালা শেষ কিন্ত মন থেকে কিছুতেই তাজ এর স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছে না । যত ভূলতে চেষ্টা করছে ততই যেন তারই আত্মার মাঝে মিশে যাচ্ছে সে । তাজ এখন তার ধরা ছোয়ার বাইরে । সে এখন অনেক দুরে চলে গেছে । তাকে নিয়ে ভাবলেও আগের মত করে তাকে ভাবতে পারছে না । সে এখন অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী । এখন তাজ শুধু তার কাছে মধ্য রাতের দুঃস্বপ্নের মত । যা কখনো বাস্তবায়িত হয় না । তবুও স্মৃতির ভারে জর্জরিত বিষন্ন মন যখন সুযোগ বুঝে সুদুর অতীতের দিকে দৃষ্টি দিতে শুরু করে তখন পাওয়া এবং না পাওয়া থেকে পেয়ে হারানোর বেদনা আরো বড় হয়ে উঠে । কষ্টটা দিন দিন বেড়েই চলছে । আহত পাখীর মত ছট ফট করতে করতে সে এক সময় পরীক্ষাটা দিয়ে দিল । তার পরীক্ষা একেবারে খারাপ হয় নাই । মান সম্মান থাকবে বলে তার নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল । কিন্ত জীবনের প্রথম পরীক্ষায় আসানুরুপ ফলাফল না হওয়ায় সে আরও ভেংগে পড়ল এবং সবার কাছে আরও বেশী করে ঘৃনিত হলো । যুদ্ধের মাঠে সে এক পরাজিত সৈনিক । জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য রেজাল্ট ভাল করা যে কত জরুরী সেদিন সে হাড়ে হাড়ে অনুভব করে ছিল । তার মনের শক্তিটা আরো দুর্বল হয়ে গেল । মেরুদন্ডহীন এক মানুষ সে । সবার মুখে ঐ একই কথা নাম্বার ওয়ান ৪২০ তার আবার রেজাল্ট ভাল হয় কি করে ? পাশ করেছে এটাই তো তার কপালের জোর । পথে ঘাটে ছোট বড় সবার মুখে এমন কথা বার্তায় সে খুব ব্যথিত হলো । একান্ত আপনজনদের এমন কষ্টদায়ক কথা বার্তায় সে আরও অসহায়ের মত চলাফেরা করতে লাগল । জ্ঞজীবনঞ্চ আবেদ সাহেবের অনেক সামাজিক কাজে বাধা দিয়েছে এবং বর্তমানে প্রেমে বাধা দিচ্ছে এমনটা ভেবে তার প্রতি আবেদ সাহেব এ সুযোগটা গ্রহন করে । রেজাল্ট খারাপ করেছে সুতরাং এটাই মোক্ষম সুযোগ । তার নামের বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে তার দাদার কান ভারী করে দিতে হবে । সমাজের চারিদিকে বিভিন্ন জায়গায় তার নামে বিভিন্ন অপপ্রচার করতে লাগলো । একদিন খেলার মাঠে তার সামনে তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর ছোট ভাই (সাথী) কে বলল, তোমরা এমন মানুষের সাথে চলাফেরা করো কিভাবে ? তোমরাতো খারাপ হয়ে যাবে । সে কে জান ? আমি তাকে তোমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি । সে আমার বড় সমন্ধির ছেলে । সে একটা নাম্বার ওয়ান ৪২০ । এ ঘটনায় জীবন আরও হতাশ হয়ে পড়ে । সে কখনো এই অপমানটা ভুলতে পারে না । সব সময় তার কানে সেই কথাগুলি ঝাঝালো হয়ে বেজে উঠে । সে ভাবে মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে ? সামান্য স্বার্থের জন্য আপনজনকে এভাবে সবার সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে একবারও ভাবলো না ? তবে সেদিনের ঘটনায় সে সাথীর কাছে আজও কৃতঞ্চ । সাথীও কাউকে ছেড়ে কথা বলার ছেলে নয় । সে অবশ্যই সেখানে বলেছিল, কে খারাপ আর কে ভাল তা আমরা ভালভাবেই জানি। আর জানি বলেই তার সাথে এভাবে মেলামেশা করি । সাথীর এমন দাত ভাংগা জবারের জন্য আবেদ সাহেব অপ্রস্তুত ছিল তাই তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন । হঠাৎ করে জ্ঞজীবনঞ্চ আবেদ সাহেবের কাছে এতটা খারাপ হয়ে গেল যে, প্রতি পদে পদে তার ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিল । এমনকি উল্টা পাল্টা কথা বলে, খারাপ পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার দাদার কান পর্যন্ত ভারী করে ফেলল । এমন পরিস্থিতিতে জ্ঞজীবনঞ্চ এর উপর সম্ভবত তার দুই চাচীও কিছুটা খুশী হয়েছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ অবাক হয়ে ভাবে । বৈচিত্রময় পৃথিবীতে কত বিচিত্র ধরনের মানুষ বাস করে । যে চাচীকে স্বপ্ন দেখিয়ে সে এ বাড়ীতে আটকে রেখেছে সেই আজ তার দুঃসময়ে এতটা খুশী । পরীক্ষার রেজাল্টের রেশ কাটতে তাকে অনেকটা ধকল সামলাতে হয়েছে । এসব অবলোকন করে ছেলের রেজাল্টে তার অসহায় বাবা আরও ভেংগে পড়ল । ছেলের রেজাল্ট নিয়ে বাড়ীতে রাজনীতি চলছে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মতি গতি ঠিক নেই । তার বাবা কিছুটা উপলব্ধি করে কাছে ডেকে তাকে বলেছিল যা হবার তা তো হয়েই গেছে এখন ইন্টারমিডিয়েট টা ভাল করে পড় যাতে এটা পুশিয়ে যায় ।



চৌদ্দ

এসএসসি পরীক্ষা শেষ, হাতে লম্বা সময় । জীবনের বড় ফুফু আলেয়া বেগমের দুই ছেলে আনিস ও মিজান তার সাথে ঐ বৎসরই এসএসসি দিয়েছে । একই সমবয়সী হবার কারনে জ্ঞজীবনঞ্চ ওদের দুভাইকে খুব আদর করে এবং ভালবাসে । লম্বা ছুটি তাই তিন জনের কোথাও ঘুরে আসার পরিকল্পনা । জ্ঞজীবনঞ্চ এর এক চাচা বিডিআর এ চাকুরী করে । পোষ্টিং যশোর, সপরিবারে সরকারী কোয়ার্টারে থাকে । অবশ্যই তার চাচাু তখন ভীষন অসুস্থ থাকায় ঢাকা, পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । তিন ভায়ের পরিকল্পনা যশোর যাবে, সেই সাথে মনিহার সিনেমা হলে ছবি দেখে আসবে । মনিহার হলে বলে একটা কথা। পরিকল্পনা মোতাবেক প্রস্তুতি পর্ব শেষ । জ্ঞজীবনঞ্চ তার পথ খরচের জন্য ৮০০ শত টাকা নিয়েছে । আর ওরা দু ভাইয়ে নিয়েছে ১৫০০ শত । আলেয়া বেগম আনিসের হাতে টাকা দেয়ার সময় আস্তে করে বলল, টাকাটা সাবধানে রাখিস কেননা জ্ঞজীবনঞ্চ এর অভ্যাস খুব একটা ভাল না । জীবন কথাটা শুনতে পায় । তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় । যাদেরকে এত ভালবাসে, তারা তাকে এমনটি ভাবে । ও যেন নিজের কানে শোনা কথাটা বিশ্বাস করতে চায় না । অন্য কেউ বললে হয়ত ওর মনে এতটা বাঁজত না । অথচ শীতের রাতে এক লেপ গায়ে দিয়ে তিন ভাই এক সাথে কত রাত কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । রাতের প্রহরে প্রহরে জ্ঞজীবনঞ্চ তাদের দুভাইয়ের গায়ে লেপ আছে কিনা দেখে নেয় । লেপ ছোট থাকায় তার নিজের শরীর অর্ধেক ঢেকে রেখে বাকী লেপটুকু ওদের দুভাইয়ের গায়ের উপর উঠিয়ে দেয় । এভাবে সে কত শীতের রাত পার করেছে তার হিসাব নেই। তাদের উপর তার ভালবাসা এমনই কাজ করত । অথচ তার আপন জনের নিকট হতে ঐ কথা শোনার পর সে পাথর হয়ে যায় । মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, না, সে ওদের সাথে ভ্রমনে যাবে না । কিন্ত আবার ভাবে যদি সে এই মুর্হুতে না যায় তাহলে ওরা হয়ত কষ্ট পাবে, কেননা ওরা তো ওর সাহসে বেড়াতে যাচ্ছে । আলেয়া বেগমের সর্তক বানী সে যে শুনেছে সেটা সে ওদেরকে বুঝতে দেয় না । ভ্রমন শেষে বাড়ী ফিরে লঞ্চ ঘাটে নেমে জানতে পারে তাদের এলাকা বর্তমানে লোনা পানির নীচে ডুবে আছে । পবনা স্লুইচ গেইট ভেংগে পুরা এলাকায় পানি ঢুকেছে । জ্ঞজীবনঞ্চ চিন্তা করে এক ফসলের দেশ । এক বছর ফসল না হলে মানুষের মাঝে হাহাকার লেগে যাবে । তার মনটা ভীষন খারাপ হয়ে যায় । তার মনে উকি মারে গরীব মানুষের কি অবস্থা হবে ? কিভাবে চলবে তাদের নিজেদের এত বড় সংসার । এসব প্রশ্নের সমাধান খুজতে খুজতে তারা একসময় বাড়ীতে এসে পৌছায় । সমগ্র এলাকা জুড়ে পানিতে থৈ থৈ করছে । সচক্ষে এটা দেখে সে আরও ভেংগে পড়ে । সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বিলের মাঝে এক ঝাক হাঁস পাখীর দিকে । যেখান থেকে বাধ ভেঙেছে সে স্থানটি দেখার জন্য সে পরেরদিন নৌকা যোগে ওর দাদার সাথে চলে যায় । এলাকার সকল গন্যমান্য লোক সেখানে জড় হয়েছে । সরকারী অনুদান ছাড়া সকলের প্রচেষ্টায় সেখানে বাধ দেয়ার পরিকল্পনা চলছে । সে মোতাবেক সুন্দরবন হতে প্রয়োজনীয় কাঠ ও সংগ্রহ করা হয়েছে । অবশ্য সেখান হতে কিছু কাঠ আবার চুরিও হয়ে যায় । সে ধিককার দেয়, হায়রে মানুষ, হায়রে চোর । যেখানে মানুষের জীবন মরণ সমস্যা, সেখান থেকে কাঠ চুরি করতে তাদের মনে একটুও বাধা দিল না । চোরের কোন ধর্ম নেই কথাটি বাস্তবের চেয়েও সত্য । যাইহোক শুধু বাকী রয়েছে মাটি এবং ঘাস ও লতা পাতা সংগ্রহের । এগুলো সকলের শ্রমের বিনিময়ে করা হবে । জীবন এ মহতী কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার জন্য একজন মাটি বহনকারী কর্মী হিসাবে নাম লেখায় । যত তাড়াতাড়ি বাধ দেয়া যাবে ততই মংগল । তানাহলে সে বছর ধান লাগানো যাবে না । আগেই বলেছি, জ্ঞজীবনঞ্চ ছিল খুবই বন্ধু প্রিয় । তার কাছে বন্ধুদের স্থানটা অনেক উপরে । সবার আগে বন্ধুদের কথায় সে প্রাধান্য দেয় । বাধের মাটি বহন করার সময় তার অন্যতম এক ঘনিষ্ট বন্ধু সফিকে দেখতে পায় খালের ওপারে মাটি বহন করছে । অনেকদিন বাইরে ছিল । তার সাথে দেখা নেই । তাছাড়া ভ্রমন করে এসেছে যার আনন্দ তাকে বলা হয়নি । এমনি আবেগে তাকে দেখার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য সে সাতার কেটে খাল পার হচ্ছিল । খালে প্রচন্ড স্রোত । খালের মাঝ পথে যেয়ে স্রোতের টানে সে আর খাল পার হতে না পেরে উল্টা ফিরে আসার ব্যর্থ চেষ্টা করে কিন্ত ততক্ষনে স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে তার শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে । অগত্যা কোন পথ না পেয়ে সে বেঁচে থাকার অদম্য বাসনায় নিজকে পানির উপর ভাসিয়ে দেয় । ভাবে হয়ত এভাবে সে ভেসে স্লুইচ গেইট এর ভিতর দিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ল নদীতে যেয়ে পড়বে । তার এভাবে ভেসে যাওয়া দেখে তার গ্রামের কয়েকজন তাকে সনাক্ত করে তাড়াহুড়া করে নিজেদের মধ্যে একে অপরের হাত ধরে শিকল বানিয়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে ধরে ফেলে । স্রোতের চাঁপে সে বাঁধের পানির নীচে পড়ে যায় এবং তার কাপড় বাঁধের খুুটির সাথে জড়িয়ে যায় । তখন বাধের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে । জ্ঞজীবনঞ্চ কে ধরতে যেয়ে তাদের ধাককায় এক লোক বাধের উপর থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হয় এবং সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য জ্ঞজীবনঞ্চ এর উপর গিয়ে পড়ে । জীবন পানির নীচে ঐ লোকটির পায়ের নীচে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকে । এক সময় সে শেষ চেষ্টা হিসেবে আরও পানির নীচে গিয়ে ঐ লোকটির পায়ের নীচ থেকে মুক্তি পেয়ে হঠাৎ অর্ধ মৃত অবস্থায় ভেসে উঠে । তাড়াতাড়ি লোকজন টেনে উপরে উঠায় । ততক্ষনে তার পরনে একটা জাংগিয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না । ঘন্টা খানেকের মধ্যে ওদের বাড়ীতে সংবাদ পৌছায় জীবন মারা গেছে । এ সংবাদের তার মা,দাদী ও চাচীরা অন্য আরেকটি নৌকা যোগে দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসে । সফির সাথে দেখা করতে যেয়ে তার এই অবস্থা এটা জেনে তার বাবা ও দাদা খুব বকা দিল । তাদের কথা, আর কত বড় হলে সে বুঝবে, বন্ধু বান্ধব ছাড়বে । তারা যাই বলুক না কেন সফি তার আত্মার আত্মীয় । সফির উপর তার অগাধ ভালবাসা । প্রয়োজনীয় মুর্হুতে সফি তাকে বিভিন্ন ভাবে সাহস দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে । সফির মা আজ আর বেঁচে নেই কিন্ত তার মায়ের স্মৃতি আজও সে বহন করে বেড়াচ্ছে । সফির মা জ্ঞজীবনঞ্চ কে খুব ভালবাসতো । এক সাথে খাওয়ার সময় দুধের পুরো সর টুকু সফিকে না দিয়ে ওকে দিত । সফিকে সে পেয়েছিল তার জীবনের দুঃসময়ের বন্ধু হিসেবে । এই সামান্য ক্ষতিতে তাকে কি ভোলা যায় ? ওর শত আঘাতেও সে কখনো অকৃতঞ্চ হবে না তার প্রতি । এই মুল্যবোধ এবং বিশ্বাসটুকু তার মধ্যে সব সময় কাজ করে । একবার একটা ঘটনা জ্ঞজীবনঞ্চ কে বেশ নাড়া দেয় । জ্ঞজীবনঞ্চ তখন সেনাবাহিনীতে দু বছর অতীত করেছে । পোষ্টিং দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় । আলীকদম ক্যান্টনমেন্ট । বার দিনের ছুটিতে সে এসে নামে সুন্দরবন সংলগ্ন লঞ্চ ঘাটে । তখন রাত পৌনে এগারটা । তার সাথে আর কোন যাত্রী নেই । চাদনী রাত হলেও খুব ভয় পাচ্ছে কেননা আর আধাঘন্টার মধ্যে চাঁদ ডুবে যাবে । লঞ্চঘাট থেকে তাদের বাড়ী চার/পাচ কিলোমিটার দুরে । সাথে বড় একটা ব্যাগ । এত পথ অন্ধকার রাতে কিভাবে যাবে ভেবে না পেয়ে সে স্থির করে মাঝপথে সফির ওখানে গিয়ে উঠবে । শান্তিময় প্রাইমারী স্কুল রেখে ওয়াপদা রাস্তা ধরতেই চাঁদ ডুবে গেল । সামনে একশ গজ দুরে শ্বশানঘাট । শ্বশানঘাটের সাথে বহু পুরাতন এক বটগাছ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে । ঘোর অন্ধকারে বটগাছের নীচে আসামাত্র তার গায়ে এক ঠান্ডা বাতাসে তার পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে । ভয়ে সে আর পথ চলতে পারে না । থমকে যায় গাছের নীচে । ভাবছে চিৎকার করবে, নাকি সাহসের সাথে পা বাড়াবে ? মাখন স্যারকে ডাকবে বলে মনস্থির করলেও এত রাতে কেউ বের হবে না ভেবে সে দোয়া ইউনুছ আর কলেমা পড়ে গায়ে ফু দিয়ে কিছুটা সাহসের সাথে পা বাড়ায় । সফিদের বাড়ী আর পাঁচশ গজ সামনে । সে এসে দেখে সফির ঘরে অন্ধকার । সে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর ঢোকে । সফি তখন ঘুমিয়ে গেছে । অন্ধকারে খুজতে যেয়ে সফির পায়ের উপর তার হাত লাগে । সফির ঘুম ভেঙে যায় । সফি ধারনা করে নিশ্চয় ঘরে চোর ঢুকেছে । সফির সাহস দেখে সে অবাক হয়ে যায় । অবশ্য সে নিজে যদি এমন ঘটনার সম্মুখীন হতো তাহলে সেদিন তার খবর ছিল । কিন্ত সফি চিৎকার ছাড়া অত্যন্ত সাহসের সাথে সে আস্তে আস্তে খুব কৌশলে হঠাৎ জ্ঞজীবনঞ্চ এর হাত ধরে ফেলে । জ্ঞজীবনঞ্চও কোন কথা বলে না এবং কোন নড়াচড়াও করে না । সফি হাত ধরে রেখেছে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, জ্ঞজীবনঞ্চ । জ্ঞজীবনঞ্চ অবাক হয়ে জিঞ্চাসা করে এই অন্ধকারের মধ্যে তুই কিভাবে চিনতে পারলি ? সফির সোজা উত্তর ভালবাসা, হ্নদয়ের আকুতি বুঝলি ? জ্ঞজীবনঞ্চ আরও অবাক হয়ে যায় । সফির ভালবাসার কাছে তার ভালবাসার আবেগ কিছুই নয়। ওর পাগলামী জ্ঞজীবনঞ্চ এর কাছে ভাল লাগত । ওরা যখন ক্লাবের কোন জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বার্তা বলতো তখন সফি হঠাৎ করে বিষয় ছাড়া একটা উদ্ভট কথা বলে ফেলতো । জ্ঞজীবনঞ্চ রাগ করে ওকে বলতো তোর কি এখন এই মুর্হুতে এই কথাটা বলা ঠিক হয়েছে ? তার একটৗ ভাল গুন ছিল, সে কখনো রাগ করতো না । তাই সে পাল্টা প্রশ্ন করে বলতো ভাল ছবিতে (সিনেমায়) কি টেলি সামাদ থাকে না ? ওর কথায় সবাই হেসে দিত । সফির এমন আচরণে জিতু বলত, ওর মৃত্যুর আগ মুর্হুতে পরিবর্তন হবে কি না সন্দেহ আছে । সফি প্রেমে পড়েছে । সে ভালবাসে তাদের বাড়ীর পার্শ্বের একটি মেয়েকে । মেয়েটিই বেশী ভালবাসে ওকে, তাই জ্ঞজীবনঞ্চ এর কাছে ওদের ভালবাসাটা খুবই চমৎকার মনে হয় । তারা দুজনে একে অপরকে মন প্রান উজাড় করে ভালবাসে । একদিন একজনের সাথে দেখা না হলে তারা অস্থির হয়ে উঠত । সফি ওদের প্রতিদিনের কথাবার্তা জ্ঞজীবনঞ্চ কে জানিয়ে আনন্দবোধ করত । জ্ঞজীবনঞ্চ গভীর মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনত । জ্ঞজীবনঞ্চও ওকে প্রায় সময় বলত ঐ মেয়েটি যেভাবে তোকে ভালবাসে তাতে তোর জীবন ধন্য । তুই ওকে বিয়ে করলে জীবনে সুখী হতে পারবি । সফির ভালবাসার মানুষটির যখন অন্যত্র বিয়ের তোড় জোড় চলছিল তখন সফির কোন ভুমিকা না দেখে ঐ মেয়েটি সফির মায়ের কাছে এসে সরাসরি প্রস্তাব করেছিল এবং তাদের দীর্ঘদিনের ভালবাসার কথা জানিয়েছিল । সফির মা রাজী থাকলেও কি অজানা কারনে সফি বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সেই রহস্য সে জ্ঞজীবনঞ্চ কে কখনো বলেনি । জ্ঞজীবনঞ্চ এর সাথে সফির ঘনিষ্ট সর্ম্পক আছে এটা জেনে ঐ মেয়েটি জ্ঞজীবনঞ্চ এর কাছে এসে তাদের জীবনের ঘটে যাওয়া স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে অঝোরে কেঁদে ছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ তাকে কথা দিয়েছিল সে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে । তাদের প্রেমকে বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে সুখী করার জন্য সে আপ্রান চেষ্টা করবে । পরক্ষনে তার এক আত্মীয় কর্তৃক তাকে একাজে না যাওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া হয় । কিন্ত তারপরও সে তার বন্ধুকে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে কিন্ত তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে সে আর সামনে এগুতে পারিনি । কিসের টানে সফি পিছু টান দিয়েছিল সেই তথ্য উদঘাটনের জন্য জ্ঞজীবনঞ্চ আর কখনো সফিকে বিরক্ত করেনি ।







পনের

যাইহোক, তখনো বর্ষাকাল চলছে । বাধ বাধার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয় । সারা উপজেলা ব্যাপি পানিতে থৈ থৈ করছে । চারিদিকে অভাবের হাহাকার । এমনই সময় জ্ঞজীবনঞ্চ এর দাদা তাদেরকে সংসার থেকে পৃথক করে দেয় । জ্ঞজীবনঞ্চ এর বাবা প্রায় সময় অসুস্থ থাকে তাই তার বাবার মুখের হাসিটা যেন আরও ম্লান হয়ে যায় । তার বাবা অবাক দৃষ্টিতে ভাবতে থাকে কিভাবে এই পরিস্থিতিতে সাতজনের খাবার জোগাড় করে সংসার চালাবে। জ্ঞজীবনঞ্চ ভাইবোনদের সবার বড় । সে তার বাবার কষ্ট এবং অনুভূতিগুলি বুঝতে পারে । কিন্ত শারিরীক সাহায্য করা ছাড়া তার আর অন্য কোন গতি নেই । সে ভাবতে থাকে বাবা, মা এবং ছোট ভাইবোনদের মুখে খাবার তুলে দিতে তাকেই এখন বড় ভূমিকা পালন করতে হবে । লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হবে । মানুষের বাড়ীতে কামলা দিতে হবে কিন্ত সে তো জীবনে কখনো কৃষি কাজ করেনি । আবার পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা মনে করে সে খুব ভেংগে পড়ে । খাবারের খোজে তাকে হয়ত অনেক দুরে কোথায় যেতে হবে । আপাতত এখুনি কিভাবে সংসার চালাবে সে চিন্তায় তার বাবা ও সে অস্থির হয়ে উঠে । কাজ করে খেলে সম্মান যাবে না এবং সবাই পরিস্থিতির স্বীকার এমনটি ভেবেই তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাধের জন্য তারা ঘাস সরবরাহ করবে । সিন্ধান্ত মোতাবেক সে তার বাবাকে নিয়ে নৌকা যোগে বাড়ী থেকে অনেক দুরে এক বিলের মধ্য থেকে লোনা পানিতে ডুব দিয়ে সকাল আটটা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত ঘাস উঠায় । তার বাবা ডুব দিয়ে ঘাস উঠালে সে তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে । তার বাবা জীবনে কখনো পরিবারের জন্য কাজ করেনি । আর আজ এতটা বয়সে এসে অসুস্থ শরীর নিয়ে সন্তানদের জন্য লোনা পানির বুক চিরে দুবলা ঘাস ছিড়ে আনছে । অসুস্থ বাবার এমন চেহারার প্রতি তার নজর পড়তে বুকটা ভেংগে চুরমার হয়ে যায় । তার বাবাও লক্ষ্য করে তার বড় ছেলে সংসারে সবার আদরে বড় হয়েছে । কখনো কষ্ট কি জিনিস অনুভব করেনি । আজ সে তার বাবাকে সাহায্যের জন্য না খেয়ে তার সাথে লোনা পানিতে ডুব দিয়ে ঘাস ছিড়ছে । বাবা ছেলে একে অপরের চোখের দিকে চোখ পড়তেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । দুঃখে, কষ্টে বাবা ছেলে দুজনেরই চোখ ছল ছল করে উঠে । কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চায় না । দুপুরে তাদের খাওয়া হয়নি । তারপর নৌকা ভর্তি করে সেই ঘাস বিকাল পাঁচটার সময় বাধে দিয়ে পঁচাত্তর টৗকা নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে আসে । তার বাবাও জীবনে কখনো ক্ষেতে খামারে কাজ করেনি । জীবনের বাস্তবতাকে মেনে সংসারের হাল ধরার জন্য তাদের এই সংগ্রাম । সারাদিন লোনা পানিতে ডুব দেয়ার কারনে রাতেই বাবা ছেলের দুজনেরই জ্বর এবং মাথা ব্যাথা শুরু হয় । জ্ঞজীবনঞ্চ এর গায়ে প্রচন্ড জ্বর আসে । মাথা উচু করার শক্তি নেই । এদিকে তার বাবারও সর্দি লেগেছে এবং সেই সাথে মাথা ব্যাথা করছে । সকালে ওর বাবা কাজে যাওয়ার জন্য জ্ঞজীবনঞ্চ কে ডাকে। জীবন যাবে না বলে জানিয়ে দেয় । ওর প্রতি ওর বাবা ভীষন রাগ করে । একদিন কাজ করে যদি এভাবে পড়ে যাও তাহলে সামনের দিনগুলি কিভাবে চলবে । তার বাবার ইচ্ছে ছিল সে নিজেই যেহেতু অসুস্থ তাই আজ নিজে না গিয়ে ছেলেকে পাঠাবে । কিন্ত ছেলে যেতে চাইছে না বিধায় তার বাবা খুব কষ্ট পায় । একা ঘাস উঠানো এবং নিয়ে যাওয়া ভীষন কষ্ট তাই সেদিন আর ঘাস টানতে যাওয়া হয়নি । সারাদিন কিছু করা হয়নি। আগামীকালের খাবার কোথা থেকে আসবে এমনটি ভেবে এবং যেহেতু সংসারের বোঝা তার বাবার উপর তাই তার বাবার অসুস্থতাকে দুরে ঠেলে দিয়ে মনের সাহসে জাল নিয়ে সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ে মাছ মারার জন্য । বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকার রাতে একাকি অর্ধ রাত পর্যন্ত জাল বেয়ে একঝুড়ি চিংড়ী মাছ নিয়ে বাড়ী ফিরে । অসুস্থ শরীর, শীতে কাপছে । তার বাবার শরীরের অবস্থা দেখে তার মায়ের চোখ দুটি পানিতে ছল ছল করে উঠে । মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না । ছোট ভাইবোন গুলি অনেক মাছ দেখে আনন্দবোধ করছে । তাদের বুঝার ক্ষমতা এখনো হয়নি । হাজারো কষ্টের মাঝে ছেলে মেয়েদের আনন্দে তার বাবা কষ্টটা কিছুটা সময়ের জন্য ভুলে যায় । সকালে খুব ভোরে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে মাছ গুলি মাথায় করে কুজো হয়ে দুই কিলোমিটার দুরে বাজারে গিয়ে ষাট টাকা বিক্রি করে আসে । তার বাবার কষ্টে জ্ঞজীবনঞ্চ ভিতরে ভিতরে কষ্ট অনুভব করে । কিভাবে সংসার চলবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি, ওর বাবা ওদেরকে এমন স্বপ্ন কখনো দেখায়নি । এতশধ ঢ়ষ লষয়ঢ়ব (দিন আনা দিনে খাওয়া) এভাবেই চলছিল তাদের সংসার । হঠাৎ একদিন ওদের কাজে যাওয়া হয়নি । ঘরে চাল ছিল না । দুপুর পর্যন্ত অনেক জায়গায় চালের জন্য ঘুরেছে । কেউ ধার দেয়নি । দেবে কেন ? ওদেরতো রোজগার নেই, শোধ করবে কিভাবে ? এসব ভেবে লোকজন ধার দিতেও চায় না । ওর মা ওর দাদীর কাছে কয়েকবার গিয়েছে । চাল থাকা সত্বেও ধার দেয়নি । ওর সেজ চাচী ও ছোট চাচীর ধারনা যদি তাদেরকে চাল ধার দেয়া হয় তাহলে তারা আর কাজ করবে না । সব সময় ধারের অপেক্ষায় থাকবে এবং অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে । তাই ওর দাদা নাকি দিতে নিষেধ করেছে সুতরাং কোন অবস্থাতেই ধার দেয়া যাবে না । বাড়ীর সবাই খেয়েছে, জীবনরা সারাদিন না খেয়ে আছে । ওর ছোট বোনটির দিকে তাকিয়ে তার চোখ দুটি স্যাতসেতে হয়ে যায় । চাল দেবার ভয়ে কেউ ওদের দিকে ভাল করে মুখ তুলে দেখছে না । না খেয়ে. আছে এই লজ্জায় সকলে ঘরের মধ্যে বসে আছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, তখনো রাতের খাবারের কোন ব্যবস্থা হয়নি । অসহায়ের মত একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে দেখছে । জীবনে ওরা কখনো উপোষ করেনি । ক্ষুধার যন্ত্রনা কি তা তারা জানে না । আর আজ সারাদিন না খেয়ে শরীর যেন কারোর চলতে চায়না । ওর ছোট ভাই বোন গুলি ঘরের ভিতর বসে বসে কাঁদছে । সে তাদের কাছে অযোগ্য বড় ভাই । সান্তনা দেবার কোন ভাষা ওর নেই । ওর বাবা ছোট ভাইবোনদের কান্নায় নিজেও এক সময় গলা ছেড়ে দিয়ে কেঁদে উঠে । রাতের খাবার খেয়ে গ্রামের সবাই তখন ঘুমিয়ে গেছে । অভুক্ত অবস্থায় ওরা কয়জন প্রানী কেবলই খাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে । ওর বাবার কান্নার আওয়াজ শুনে ওর দাদী তার দাদার উপর ভীষন রেগে যায় । ওরা কাজে যেতে পারেনি বলে সবগুলো প্রানী সারাদিন না খেয়ে আছে এবং এখনো তারা না খেয়ে কান্নাকাটি করছে । সবতো রাতেই মারা যাবে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর দাদীর এমন কথায় ওর দাদা ওদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখিয়ে সেই রাতে দুই কেজি চাল দেয় । এভাবেই দুই বেলা খেয়ে একবেলা না খেয়েই ওদের সংসার চলতে থাকলেও জ্ঞজীবনঞ্চ কখনো তার বন্ধু বান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনদের জানতে দেয়নি । হঠাৎ করে তারা বাবা ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ে । ঘরে খাবার কিছু নেই । চিকিৎসা করাবে কিভাবে । জ্ঞজীবনঞ্চ তো কোন কাজ জানে না । চাকুরীও করে না । লেখাপড়া শেষ হয়নি তার এক আত্মীয় শহীদুল্লাহ সাহেবের এমন যুক্তিতে ওরা আবার ওর দাদার সংসারে চলে যায় । দাদার হোটেলে যোগ দিয়ে জ্ঞজীবনঞ্চ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ।



ষোল

জ্ঞজীবনঞ্চ এবার সবকিছু বাদ দিয়ে সে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয় । কিন্ত সে মনোযোগ বেশীদিন সইল না । অভ্যাস যার খারাপ সে কেমনে ভাল থাকবে ? সে আবার জড়িয়ে যায় গ্রাম্য রাজনীতিতে। সমাজের চারিদিকে উচু শ্রেনীর মানুষের সীমাহীন দুর্নীতি, গরীব মানুষের প্রতি অন্যায় অবিচার চলছে । অত্যাচার আর জুলুমের মধ্যে তাদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এসব তাকে চরমভাবে আঘাত করে । শোষিতের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য অদম্য স্পৃহা তার । ভাবতে থাকে কি ভাবে এর প্রতিকার করা যায় ? তার অর্থ নেই, বল নেই । কিভাবে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিবে, সেই চিন্তায় সে সারাক্ষণ বিভোর থাকে । এর প্রতিরোধ করার সাহস তার থাকলেও নেই শক্তি । তাই সে শক্তির সন্ধানে অত্যন্ত সুকৌশলে ক্লাব গঠনের পরিকল্পনা করে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর ঘনিষ্ট বন্ধু হারুন । সে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । সে হারুনকে তার অনুভূতির কথা জানায় । হারুন শুনে তাকে বলে, সেও এমনটি ভাবছে । তার অনুপ্রেরণায় জ্ঞজীবনঞ্চ নতুন করে শক্তি ফিরে পায় । ক্লাব গঠন করে হারুনকে সভাপতি করে সে হয় সহসভাপতি । এলাকায় যারা মাতব্বর শ্রেনীর বলে পরিচিত তাদের প্রত্যেক ফ্যামিলি হতে সমবয়সী যারা লেখাপড়া করছে তাদেরকে নিয়েই এই ক্লাব গঠিত হয় । ক্লাব মানে খেলাধুলা, আনন্দ ফূর্তি এসব উদ্দেশ্য থাকলেও এর মুল উদ্দেশ্য ছিল একটাই যাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কেউ যেন মাথা তুলে কথা বলতে না পারে । কারণ মাতব্বরদের কারোর না কারোর ছেলে বা ভাই এই ক্লাবের সাথে জড়িত । জ্ঞজীবনঞ্চ এখন আর একা নয় । তার এখন অনেক শক্তি। প্রথমে দু চারটা অন্যায় কাজে বাধা দিলে তার ও এবং ক্লাবের অন্যান্য ছেলেদের প্রতি চরম আঘাত আসতে থাকে । জ্ঞজীবনঞ্চ সকলকে ঐক্য বজায় রেখে এক থাকার সাহস জোগায় । তাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে না পেরে তারা জ্ঞজীবনঞ্চ কে পদদলিত করে চরমভাবে আঘাত করতে থাকে । তাকে প্রকাশ্যে মিটিং মিছিলে ৪২০ উপাধি দিয়ে সাধারণ জনগনের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে । সাধারণ মানুষও তার সর্ম্পকে তেমনটা ভাবতে থাকে । কিন্ত তারা জানে না, তাদের স্বাধিকারের কথা বলতে গিয়ে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে যেয়ে সে আজ ঐ উপাধি পেয়েছে । স্বার্থপর বিবেকহীন মানুষের কাজকর্মে এক সময় সেও তার নিজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে । গভীর ভাবে সে ভাবতে থাকে। সে ভাবে, যাদের জন্য সে নিজের কথা ভাবে না । যাদের জন্য তার এই আহামরি, সেই তারাই তাকে কটাক্ষ করে । যাদের জন্য সে চুরি করে, তারাই যদি চোর বলে তাহলে সে কাদের জন্য চুরি করবে ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুজে পায় না সে ।





সতের

ফাষ্ট ইয়ার শেষ করে জ্ঞজীবনঞ্চ যখন সেকেন্ড ইয়ারে পা রাখল তখনই তারই ভাবনায় এলো নাজমা নামের ষোড়শী যৌবনা । ব্যর্থভরা জীবনে, অভাবের চরম কষাঘাতে জর্জরিত যার জীবন, সে যে পুনরায় কারোর ভালবাসা পাবে সে আত্ম বিশ্বাস সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে । তাই মনের মাঝে যার মুখচ্ছবি বার বার ভেসে উঠে তার কাছে তার মনের লুকিয়ে রাখা ভালবাসার কথা বলতে সাহস পায় না । তবুও আবার যেন কিসের আকর্ষনে সে মনের ভিতর লুকিয়ে লুকিয়ে পুষতে থাকে তারই ছায়া । তার সর্ম্পকে সে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে । ওর দু ভাই এর সাথে জ্ঞজীবনঞ্চ এর ঘনিষ্ট বন্ধুর সর্ম্পক । ওদের স্কুলে বাৎসরিক স্পোর্টস উপলক্ষে নাটকের রিহার্সেল হচ্ছে । একদিন রাতে রিহার্সেল শেষে ওর ছোট ভাইয়ের সাথে ওদের বাড়ীতে যায়, তখন রাত একটা বাজে । রাতে খাওয়ার সময় নাজ ঘুমানো ছিল এবং ওর পাশে বসেই ওরা খাওয়া দাওয়ার কাজটা সেরে ফেলে । নাজ ঘুমের ভান করে থাকলেও সে জেগেই ছিল । পরেরদিন স্কুল ছুটি শেষে জ্ঞজীবনঞ্চ এর ফুফাতো বোন সালমার সাথে নাজ সহ আরো কয়েকজন মেয়ে বাড়ী ফিরছিলো । জীবন বাজারে ওর দাদার একটা প্রয়োজনীয় কাজে এসে ঠিক সে সময় বাড়ী ফিরে যাচ্ছিল । সালমা জ্ঞজীবনঞ্চ কে ডাক দেয় । সে দ্রুত পায়ে এসে ওদের সংগী হয়ে যায় । বিভিন্ন কথার এক ফাকে নাজ সালমাকে ফিস ফিস করে বলল, গত রাতে একজন মানুষ আমার পাশে বসে ভাত খেয়েছে । কে ভাত খেয়েছে সালমা উৎসুক ভাবে জানতে চাইলেও তার বুঝতে বাকী থাকে না । জ্ঞজীবনঞ্চ সালমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে । সালমা বলে সে এমনটাই ভাবছে । সালমা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে এতদুর ? নাজ প্রতিবাদ করে না । নাজমার এমন আচরণে জ্ঞজীবনঞ্চ যেন একটু বেশী বিশ্বাস ফিরে পায় । তাই সে সকলের উদ্দেশ্যে বলে, যে লোকটি গত রাতে গিয়েছিল, পাশে বসে ভাত খেয়েছে অথচ এতকিছু জানার পরও অনেকে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল । অতিথির সাথে একটি কথাও বলেনি । এমন কথার জন্য সালমা বলল, বুঝেছি এসবই কেমন কেমন যেন মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে যা সন্দেহ করেছিলাম তাই । নাজ কড়া মেজাজের মেয়ে হয়েও কোন কথার প্রতিবাদ করে না । জ্ঞজীবনঞ্চ আরও একটু সাহস ফিরে পায় । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনের মধ্যে আবারও স্বপ্ন দেখা শুরু হয় । ভালবাসার কোন গভীরতা নেই, এটা সীমাহীন, কাউকে ভালবাসলে এটা কমে যায় না বরং ভালবাসা বৃদ্ধি পায় । এ সত্যকে উপলব্ধি করে নাজকে না জানিয়ে সে নিজের অজান্তে অনেক ভালবেসে ফেলেছে । আস্তে আস্তে একটু একটু করে ভালবাসার গন্ধ ছড়িয়ে প্রচার হতে শুরু করেছে । সে এক সময় নাজকে চিঠি দেয় । সফি কমন রুমের সামনে লিখে রেখেছে তাজ এখন নাজ । এটা নাজ এর চোখেও পড়েছে । নাজ এর বান্ধবীরা ওকে অনেকে অনেক ধরনের কথাও বলছে । ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার বাবা । তার একটা প্রেষ্ট্রিজ আছে । তার বাবা জানতে পারলে অন্য শিক্ষকদের কাছে ছোট হয়ে যাবে তাছাড়া তাকে অনেক বকা শুনতে হবে এমন ভাবনায় নাজ জ্ঞজীবনঞ্চএর উপর অভিমানে ভীষন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। নাজের ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ জানতে পেরে জ্ঞজীবনঞ্চ ভাবে সে আসলে সত্যিকারের প্রেমিক না । সে বোকার রাজ্যে বাস করছে। কেননা প্রেম করার আগেই তার বন্ধুরা জেনে যায় । তার পেটে কোন কথা থাকে না । এই সব বাচাল দিয়ে কি প্রেম হয় ? প্রেম করতে হয় লুকিয়ে যাতে কেউ না জানে । সমাজ বলে একটা কথা আছে তো । যদি ছেলেটৗর ব্যাপারে মেয়ের পরিবার থেকে সম্মতি না জানায়, তাছাড়া প্রচার হয়ে গেলে যদি তার সাথে বিয়ে না হয় এবং পরবর্তীতে বিয়ে নিয়ে সমস্যা হতে পারে । এ সমস্ত চিন্তা ভাবনা করেই একটা মেয়েকে প্রেমের দিকে এগুতে হয় । কেন সে সবাইকে বলতে গেল ? সে ভাবে তার জীবনে আবার ভূল সিদ্ধান্ত । হয়তবা নাজও জ্ঞজীবনঞ্চ কে তেমন ভাবে মনে প্রানে চায় না । কেননা এই ঘটনার দুই তিন দিন আগে জ্ঞজীবনঞ্চ এর ফুফাতো ভাই মিজান নাজকে একটা চিঠি দিয়েছে । মিজানের দিকে নাজ এর ইচ্ছেটা বেশী । মিজানের চিঠি দেয়ার ব্যাপারটা সালমা ও জ্ঞজীবনঞ্চএর জানা ছিল না । জানা থাকলে সালমা এবং জ্ঞজীবনঞ্চ নাজ এর ব্যাপারে এতটা আগ্রহী হতো না। কেননা সালমারই ভাই মিজান । তার জানা থাকলে সে অবশ্য জ্ঞজীবনঞ্চ কে তার আপন ভাই এর ব্যাপারটা জানাতো । জ্ঞজীবনঞ্চও জানে না, নাজকে মিজান ভালবাসে তাই একদিন কথার ছলে জ্ঞজীবনঞ্চ যে, নাজকে ভালবাসে সেটা মিজানকে বলে ফেলে । মিজান জ্ঞজীবনঞ্চএর এই কথাটা ভালভাবে নেয়নি । পরেরদিন নাজ স্কুল থেকে ফেরার পথে মিজান একা পেয়ে ওকে অনেক কথা শুনিয়ে দেয় । এক সাথে দুই জনের সাথে যে, ভালবাসা হয়না সেটাও তাকে হাড়ে হাড়ে শিখিয়ে দেয় । নাজ কোন কথা না বলে চলে আসে । পথিমধ্যে নাজ জ্ঞজীবনঞ্চ কে পেয়ে সে কর্কস ভাষায় মিজানকে সে কি বলেছে তা জানতে চায় এবং হুশিয়ার করে দিয়ে বলে এবার যদি আর কোনদিন এধরনের কথা সে শোনে, তাহলে তার ভাইকে বলতে বাধ্য হবে । জ্ঞজীবনঞ্চ উত্তরে বলেছিল, জ্ঞসে দুঃখ পেলেও খুশী হলো জেনেঞ্চ । বেহায়ার মত কথা কয়, লাজ শরম নেই আরও কত কি হিজিবিজি একটানা বলে গেল নাজ । মহা প্রেমিক দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে একটু নরম সুরে অর্থাৎ ভীতু হয়ে বলল, তোমার ভাইকে কিছুই বলার প্রয়োজন নেই যা বলার সে নিজেই বলবে । ঐ মুর্হুতে তাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য সে আরও গাল বাড়িয়ে বলল, তার ভাইয়ের অনুমতি নিয়েই সে এ কাজটি করেছে । এ কথায় নাজ অনেকটা নরমও হয়ে যায় । মনে মনে জ্ঞজীবনঞ্চ ভাবে যাক বাঁচা গেল । আর যাইহোক বাড়ীতে যেয়ে আর ওর মাকে বলবে না । জ্ঞজীবনঞ্চ যাচ্ছিল সুকলের মাঠে ভলিবল খেলতে । ওর বিকালটাই যেন মাটি হয়ে গেল । হাজার চেষ্টা করেও মনটা ফ্রি করতে পারছে না । হাসি খুশী মনটার উপর যেন বজ্রপাত হয়েছে । ওর মন ভেংগে যায় । সে যদি জানত যে, মিজান তাকে ভালবাসে তাহলে সে নিজের কষ্ট বুকে চেপে রাখত । সে বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে খেলার মাঠে যায় । খেলা শেষে সন্ধ্যা বেলায় নাজ এর বড় ভাইয়ের সাথে জ্ঞজীবনঞ্চ দেখা করে সবকিছু বলে আসে । জ্ঞজীবনঞ্চ যখন ওর বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে তখন নাজ জ্ঞজীবনঞ্চ কে দেখেছে তার ভাইয়ের কাছে যেতে । জ্ঞজীবনঞ্চ ওর বড় ভাইকে বলে, তোদের এখানে তার আসা যাওয়া আছে বলে অনেকে ভাল চোখে দেখে না । হয়ত তোর কাছে এমন প্রস্তাবও আসতে পারে যে, সে আসে তোর বোনের সাথে প্রেম করার জন্য । জ্ঞজীবনঞ্চ ওকে আরও আশ্বাস দিয়ে বলে, যদি এমন ঘটনা কখনো ঘটে তাহলে সে তাকে জানিয়ে করবে । আরো বলে যদি কোনদিন নাজ এর যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারে তবে তার কাছ থেকে তার বোনকে চেয়ে নেবে । সুতরাং কারোর কথা শুনে যেন সে তার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট না করে । জ্ঞজীবনঞ্চএর এমন সরাসরি কথায় ওর বড় ভাই খুশী হয়ে যায় । সে তাকে বলে তুই চিন্তা করিস না । যে সরাসরি এভাবে কথা বলতে পারে তার দ্বারা আমার কোন ক্ষতি হবে না । বরং এমন কথা বার্তায় তাদের বন্ধুত্ব আরো বেড়ে যায়। জ্ঞজীবনঞ্চ আর পিছন ফিরে তাকায় না । জ্ঞজীবনঞ্চ প্রথমবার যখন চিটাগাং গিয়েছিল তখন নাজ এর জন্য ঝিনুকের মালা কিনেছিল। বাড়ী ফেরার পথে ঢাকায় নাজ এর বড় ভাইয়ের সাথে ও দেখা করে । দুজনে একটি বৈদ্যুতিক বাতির নীচে বসে পারিবারিক গল্প নিয়ে ব্যস্ত ছিল । একসময় নাজ এর বড় ভাই তাকে বলল, জ্ঞজীবনঞ্চ তোর জন্য মায়ের কাছে আমাকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে । মা আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে তোকে জানানোর জন্য। নাজ এর সাথে তোর মেলামেশাটা বাবা মা কেউ পছন্দ করছে না, তাই তুই আর ওকে কোন চিঠিপত্র দিস না । তার এমন খোলাখুলি কথাতে জ্ঞজীবনঞ্চ আর কখনো যোগাযোগ করবে না বলে রাজী হয়ে যায় তবে একটা দাবী করে । আর সেটা হলো, তার জন্য ঝিনুকের মালা নিয়ে এসেছে । এবারের জন্য যেন তাকে দেয়ার অনুমতি দেয় । ওর ভাই হেসে বলে, তুই আসলে খুব ভাল, তোর মনটা একেবারে পরিষ্কার । আচ্ছা দিস । জ্ঞজীবনঞ্চ বাড়ীতে এসে নাজকে মালাটা দেয়ার সময় তার ভাইয়ের অনুমতি আছে বলে জানিয়ে দেয় । সুতরাং নাজ আর নিতে অস্বীকার করে না । মিজানকে টপকে তাকে স্থান করে নিতে হবে নাজ এর জীবনে । এমনটি প্রত্যয় নিয়ে সে ঠান্ডা মাথায় ধীর গতিতে এগুতে থাকে । সে ভাবে, যেখানে ভালবাসা আছে সেখানে নিন্দাও আছে । নিন্দাকে উপেক্ষা করে নিজের ভালবাসাকে জয় করে নিতে হবে এটাই বাস্তব । অতীতকে ভুলে যাবার জন্য বড় ভালবেসেছিল সে নাজকে । নাজ এর মিষ্টি মুখের কাছে সে এমন সময় হেরে গেল যখন তার পরীক্ষা সামনে। সে অকুল সমুদ্রে ভালবাসার তরী ভাসিয়ে দিল । নাজ এর ঘনিষ্ট বান্ধবী লাইলী জ্ঞজীবনঞ্চএর হয়ে অনেকবার প্রস্তাব করেছে । নাজ কিছুটা নমনীয়তা প্রকাশ করেছে জ্ঞজীবনঞ্চএর উপর । একদিন ওদের স্কুল শেষে লাইলী জ্ঞজীবনঞ্চ কে ডেকে নাজ এর সামনে বলল, জ্ঞজীবনঞ্চ তোমাকে নাজ এর প্রাকটিক্যাল খাতাটা একে দিতে হবে । জ্ঞজীবনঞ্চ মাথা নেড়ে সায় দেয় । নাজ জানিয়ে দেয় সে কাজের ছেলের মারফৎ বিকালে পাঠিয়ে দেবে । নাজের মুখ থেকে এমন কথা শুনে জ্ঞজীবনঞ্চএর মন ভরে উঠে প্রফুল্লতায়, এক অনাবিল আনন্দে । জ্ঞজীবনঞ্চ ভাবে মিজানের অনুুপস্থিতিতে হয়ত নাজ মিজানকে ভুলে গেছে । আর তাছাড়া জ্ঞজীবনঞ্চ গোপনে ইতিমধ্যে নাজ এর কাছে আরও দুটি চিঠি দিয়েছে । কোন উত্তর না দেওয়াতে সম্মতি আছে বলে মনে করে । জ্ঞজীবনঞ্চ নাজের সুন্দর রুপ দেখে ভালবাসেনি । সে ভালবেসেছে তার সুন্দর হ্নদয় টাকে। সৌন্দর্য তো সাময়িক মোহ মেটায় মাত্র । কিন্ত সুন্দর মন-মানসিকতা এনে দেয় অনাবিল আনন্দ । জ্ঞজীবনঞ্চএর একান্ত কামনা, দাম্পত্য জীবনে সুখী মানুষ হওয়া । আর সুখী হতে হলে প্রয়োজন একটি সুন্দর মনের । তাই জ্ঞজীবনঞ্চ এর আর্থিক প্রাচুর্য না থাকলেও ভালবাসার প্রাচুর্যে তাকে সুখী করার এক প্রানবন্ত প্রয়াস । পরেরদিন বিকালে নাজদের বাড়ীর কাজের ছেলে দিয়ে গোপনে জ্ঞজীবনঞ্চএর কাছে প্রাকটিক্যাল খাতা পাঠিয়ে দেয় । খাতার ভিতর জীবন্ত গোলাপের পাপড়ী । জ্ঞজীবনঞ্চ বলে নাজ, তুমি এই ফুুলের পাপড়ীর চেয়েও অনেক সুন্দর । ফুলতো জড় পদার্থ । দুদিন পরেই শুকিয়ে যাবে । কিন্ত তোমার ভালবাসা আমার আত্মার সাথে মিশে থাকবে চিরকাল । তোমার জীবনের ফুল আমি সারা জীবন সতেজ করে রাখবো । তোমার জীবনের নৌকাখানি সঠিক ঘাটে বেধেছ । তুমি হাত বাড়িয়ে দিলে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না । নাজ তার বাবা ও মাকে ভীষন ভয় পায় । ভয় পায় জ্ঞজীবনঞ্চও । এখানে ভয় ঠিক বলা যাবে না কেননা সে তাদেরকে অতিশয় সম্মান করে । জ্ঞজীবনঞ্চ কে তার বাবা মা একেবারে পছন্দ করে না । নাজ এর বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষক । জ্ঞজীবনঞ্চ নাজ এর পিছনে ঘুরছে এটা তার বাবা মা জেনে গেছে । নাজ এর মা তো জ্ঞজীবনঞ্চএর ছায়া পর্যন্ত দেখতে পারে না । শুধু তাই নয়, ছেলেদেরকেও তার সাথে মিশতে কঠোরভাবে নিষেধ করত। তার বাবা মার এমন অপছন্দের জন্য নাজও তাকে সেভাবে কোনদিন ভালবাসার কথা বলেনি । ছোট বেলায় স্কুল ফাকি, দাদার পকেট থেকে খুচরা পয়সা চুরি করা, রেজাল্ট খারাপ, পড়াশুনা বাদ দিয়ে ভিলেজ পলিটিক্স করা, সবার মুখের উপর সত্য/মিথ্যা যাইহোক বলে দেয়া, তাছাড়া বড়দের চেয়ে সব সময় দু লাইন বেশী বোঝার কারনে এ সকল গুনের সমন্বয়ে বাইরে থেকে জ্ঞজীবনঞ্চএর প্রতি মানুষের একটা ভুল ধারনা ছিল । এত অল্প বয়সে যে মেয়েদের পিছনে ঘোরে তাকে তো আর কেউ চরিত্রের সার্টিফিকেট দিতে পারে না । কিন্ত যখন তার একান্ত সান্নিধ্যে কেউ মিশেছে তখনই তারা তার আপন বন্ধু হয়ে গেছে । নেশা অথবা ধুুমপানের অভ্যাস ছিল না । সে কখনো তার বন্ধুদের খারাপ হওয়ার কোন পরিকল্পনা দিত না । প্রতিবাদ করার জন্য সবাইকে উৎসাহ দিত । যাইহোক, তখনকার দিনে সমাজে চাষী এবং কারিগর নিয়ে বেশ হৈ চৈ ছিল। বিশেষ করে ভোটের সময় হলে এটা আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠত । জ্ঞজীবনঞ্চএর আজম্মের সাধনা মানুষের গড়া সমাজের এই কুসংষ্কার ভাঙতে হবে । মানুষে মানুুষের ভেদাভেদ দুর করতে তাকে এগিয়ে আসতে হবে । সে নাজকে বিয়ে করে এই সমাজ ভেংগে প্রমান করতে চেয়েছিল এটা নিছক কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয় । এসব কুসংস্কার নিয়ে নাজ এর বাবা মা প্রচন্ড বাড়াবাড়ি করত । নাজ এর বাবা একবার বাড়ীর কাজের ছেলে রাজ্জাককে ডেকে বলেছিল এই দেখতো জ্ঞজীবনঞ্চ এর মাথায় চুল লম্বা আছে কিনা ? ধরা যাবেতো ? রাজ্জাকের প্রশ্ন কেন স্যার ? ওকে একদিন পিটাতে হবে । কেন স্যার ? আরে সে তো নাজ এর দিকে হাত বাড়িয়েছে । চাল চুলার ঠিক নেই, তাতে আবার জোলা । কুজোর আবার চিৎ হয়ে শোবার স্বপ্ন । রাজ্জাকের সোজা উত্তর স্যার, ও তো ভাল ছেলে কিন্ত এই ব্যাপারটাতো জানতাম না । রাজ্জাকের বাড়ী জ্ঞজীবনঞ্চ দের গ্রামে এবং একই পাড়ায় । তাই সে নাজ এর বাবার পরিকল্পনা জ্ঞজীবনঞ্চ কে বলে দেয় । তার মুখে এই কথা শুনে জ্ঞজীবনঞ্চ লাফিয়ে উঠে । জ্ঞজীবনঞ্চও ছেড়ে দেবার বান্দা নয় । সেও রাজ্জাককে বলে দেয়, সে যেন গিয়ে বলে যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে যেন উনি উনার সাহস দেখান । রাজ্জাকের এমন কথায় নাজ এর বাবা কিছুটা নমনীয় হয়ে আসে । আজকাল কার ছেলেদের মতিগতি বুঝা যায় না । আমিতো মেয়ের বাবা । সেতো ছেলে, গোলযোগ করলে আমারই ক্ষতি । শিক্ষিত মানুষ এসব ভেবে হয়ত আর সামনে এগুতে পারেনি । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনে সাহস আছে এই জন্য যে, নাজ এর দুঞ্চভাই ও ছোট বোন তার পক্ষে আছে । তাদের সাথে তার একটা ভাল সর্ম্পক আছে । সে প্রাকটিক্যাল খাতা একে ফেরত দেয়ার সময় তাকে আরেকটি চিঠি দেয় । যে চিঠি ছিল জীবনের শ্রেষ্ট চিঠি । সন্ধ্যা আটটার সময় আরম্ভ করে ভোর ছয়টায় শেষ করেছিল এই চিঠিটি । এত বড় চিঠি সে আর কাউকে লেখেনি । তখনকার দিনে একটা কাগজ ভাজ করলে আট পৃষ্ঠা হতো এমন একটা কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় লেখা । এত বড় চিঠির প্রতিটি শব্দ ও লাইনে ছিল হ্নদয়ের আকুতি । এক ছন্দের মহাসমারোহ । হ্নদয় স্পর্শমর্মী কথা । নাজ তাকে বলেছিল তোমাকে ভাল না বাসলেও চিঠিকে ভালবেসেছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ট উপহার । সাহিত্যের ছড়াছড়িতে তোমার জীবনের সত্য ঘটনাগুলো যে উপস্থাপন করেছো তা সত্যিই বেদনাদায়ক । নাজ ছিল চাপা স্বভাবের ভিতরে ভিতরে জীবনকে ভালবাসলেও মুখ খুলে কোনদিন তাকে বলেনি । তার নিরব সম্মতিতে জ্ঞজীবনঞ্চ তার বেঁচে থাকার অবলম্ব্বন ভাবতো । এভাবে তার ভাঙাগড়া জীবনে আশার আলো পেয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মায়ের হুশিয়ারী এবার যেন রেজাল্ট খারাপ না হয় । ভিলেজ পলিটিক্স, প্রেম, আর পড়াশুনার ভিতর দিয়ে এগুচ্ছে তার দিন গুলি । হঠাৎ তার বাবা আবার ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ে । এবার সবাই তার বাবার উপর ভরসা ছেড়ে দিয়েছে । কখন যে কি হয়ে যায় সে চিন্তায় সে বিভোর হয়ে পড়ে । বাবা না থাকলে হয়ত তার এক অচেনা অজানা পথের দিকে যাত্রা শুরু হবে । লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে । মানুষের মত মানুষ হতে না পারলে জ্ঞজীবনঞ্চএর সকল সত্য স্বপ্ন গুলো কাচের পাত্রের মত ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে । সে নাজকে পাবে না । ভাঙতে পারবে না এই কুসংস্কার সমাজ । পাহাড় সম চিন্তা মাথায় নিয়ে সে ঘুরতে থাকে ।




আঠারো

একদিন সকালে জ্ঞজীবনঞ্চ এর বাবার হঠাৎ ভীষন পেট ব্যাথা শুরু হয় । ব্যাথার যন্ত্রনায় ছট ফট করছে । বাড়ীর লোকজন সব জড় হয়েছে । আত্মীয় স্বজনেরা আসতে শুরু করেছে । জ্ঞজীবনঞ্চ বুঝতে পারে না, কি ঘটতে যাছে তার জীবনে। তার দাদা তাকে ডাক্তার আনার জন্য পাঠায় । সে দ্রুত পায়ে হেটে ডাক্তারের বাড়ীতে যেয়ে তার বাবার অবস্থার কথা বর্ননা করে ডাক্তারকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে । ডাক্তার বলে তুমি যাও, কিছুক্ষণের মধ্যে আমি চলে আসবো । ডাক্তারের এমন আশ্বাসে সে বাড়ী চলে আসে । এর মধ্যে তাকে তার বাবা কয়েকবার খুজেছে । বাড়ী আসলে একজন তাকে বলল, তোর বাবা তোকে কয়েকবার ডেকেছে । ওর দাদী বলল, ভাত খেয়ে তারপর তোর বাবার সাথে দেখা করে আয় । পুকুর পাড়ে মেসওয়াক করতে করতে সে ভাবে বাবা কেন ডেকেছে ? ডাক্তার এখনো আসেনি তার বাবাকে সে কি বলবে, এসব ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকে । ভাবতে থাকে আরেকবার অসুখের সময় সে তার বাবাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য মংলারপোর্টে নিয়ে গিয়েছিল । সে ওখানে ওর বাবাকে আপেল কিনে দিয়েছিল । সে আপেলগুলি পেয়ে তার বাবা ছোট বাচ্চাদের মত আনন্দ করেছিল আর বলেছিল বাবা আপেলগুলি খেয়ে জীবনে খুব তৃপ্তি পেলাম, আমার জীবনটা ধন্য হয়ে গেল । তার বাবার এমন কথায় সে আরও আপেল কিনে দিয়েছিল । ভাবতে থাকে এবার তার বাবাকে আপেল কোথেকে এনে দিবে । এদিকে তার বাবা তাকে তার ঘর থেকে বের করে দোতলার নীচে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। অর্থাৎ তার দাদার ঘরের বারান্দায় । লোকজনেরা ধরাধরি করে দোতলার বারান্দায় নিয়ে এলো । জ্ঞজীবনঞ্চ যাবে তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য এমন সময় তার বাবা বলল, আমাকে উঠিয়ে দাও । তার বাবার মাথা ধরে সোজা করে বসিয়ে দিতে জ্ঞজীবনঞ্চ এর সাথে চোখাচোখি হতেই জবান বন্ধ হয়ে গেল । সবাই চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল । জ্ঞজীবনঞ্চ তখনো বুঝতে পারে না তার বাবা তাদেরকে ফাকি দিয়ে ওপারে চলে গেছে । সে দৌড়ে বারান্দায় উঠে বলে কি হয়েছে, তোমরা এমন করছ কেন? পাশ থেকে একজন বলল, তোর বাবা তোদেরকে ফাকি দিয়েছে । সে মুর্হুতের মধ্যে দ্বিগবিদিক ঞ্চান হারিয়ে পড়ে যায় । তার মা সারা জীবনের সংগীকে হারিয়ে গুলি খাওয়া আহত পাখীর মত ছট ফট করতে থাকে । ছেলের গলা জড়িয়ে আকাশ বাতাস ফাঁটিয়ে কাঁদছে । এক মুর্হুতের মধ্যে বাড়ীর মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল । ওদেরকে সান্ত্তনা দেয়ার ভাষা কারোর নেই । ওরা এতিম হয়ে গেল । সে তার বাবার সাথে কথা বলতে পারেনি। বাবা কি বলতে চেয়েছিল তার জানা হলো না । তার বাবার সাথে ইহকালে আর দেখা হবে না । তার বাবার জীবনের শেষ ইচ্ছেটা বড় ছেলেকে বলতে পারিনি । হয়তবা বড় ছেলে হয়ে ছোট ভাইবোনদের দেখা শুনার দায়িত্ব দিয়ে যেত এমনটি ধারণা তার কিন্ত তারপরও তার বাবার মুখ থেকে শোনা হলো না সেই অমিয়বানী । তার বাবা অনেক কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছে । এসব ভাবতে তার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে । আখেরাতে শেষ বিচারের দিনে দেখা হলে তার বাবাকে সে কি জবাব দেবে ? এসব প্রশ্ন তাকে সব সময় তাড়া করে ফেরে । সে আজও এসব ভেবে ভীষন কষ্ট পায় । পড়ার জন্য তার বাবা তাকে খুব মেরেছে, তাই সে সেই স্মৃতি মনে করে আরও বেশী কষ্ট পাচ্ছে । তাকে কেউ আর শাসন করবে না, কেউ আদর করে ডাকবেও না। সে আর কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারবে না । সে জীবনে তার বাবাকে আর আপেল কিনে দিতে পারবে না । এসব ভেবে নীরবে একা চোখের পানি ফেলে বাবার জন্য দিনে রাতে সব সময় দোয়া করে যেন তার বাবা জান্নাত বাসী হয় ।






উনিশ

জ্ঞজীবনঞ্চ এর ফুফাতো ভাই মিজান রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবে । সে প্রেক্ষিতে ওর বড় ভাই আনিস ও জ্ঞজীবনঞ্চ খুলনা পর্যন্ত মিজানের সহযাত্রী হয় । খুলনায় মিজান যে মেসে থাকত ওরা সবাই সেই মেসে যেয়ে উঠে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর আরও কয়েকজন বন্ধু রফিক, সফি, বাবুল ওরা অন্য মেসে থাকে । ঐদিনই সন্ধ্যায় তারা সকলের সাথে দেখা করে এলো । পরের দিন বিকালে সকলে মিলে শহর ঘুরবে । প্রোগ্রাম মোতাবেক তারা সবাই ঘুরতে গেল । হঠাৎ বাবুল, রফিক ও সফি নির্দিষ্ট সময়ের পুর্বে ওরা ওদের মেসে চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পর মিজান, রশিদ ও শামীম চলে আসে । সর্বশেষ জ্ঞজীবনঞ্চ ও আনিস ফিরে আসে । ওরা ফিরে আসার পর মিজান জ্ঞজীবনঞ্চকে বলে তার ব্রিফকেস চুরি হয়েছে । রুমের ভিতর সব জিনিস ঠিক আছে শুধু ব্রিফকেস নেই । তাই মিজান ও রশিদের সন্দেহ হয় রফিক, সফি ও বাবুলের উপর কেননা তারা আগেই দল ছুট হয়ে চলে এসেছে । ওদের কাছে জিঞ্চাসা করা হলে তারা ঘটনাটি জানে না বলে জানায় । ওদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল মিজান ও রশিদ । কিন্ত জ্ঞজীবনঞ্চ বন্ধুত্বের টানে বাধা দেয় । সত্যি যদি ওরা নিয়ে থাকে তাহলে ওদের কাছ থেকে সে বের করতে পারবে এমনটি বিশ্বাস ছিল তার । তাই সে আর পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায়নি । এদিকে মিজানের আর তিনদিন বাকী আছে মেডিকেলের পরীক্ষা । ওর মাথায় কাজ করছে না । মিজান পাগলের মত হয়ে গেছে । সেই সাথে আনিস ও জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনটাও খারাপ হয়ে গেল । একটা আনন্দ নিয়ে এসেছে আর তা সব মাটি হয়ে গেল । ঐ ব্রিফকেসের মধ্যে জ্ঞজীবনঞ্চ এর ও আনিসের দুটি করে সার্টিফিকেট ছিল । ছিল ওর দুই বোনের দুটি ঘড়ি । আনিস ও জ্ঞজীবনঞ্চ এর সার্টিফিকেট আনার উদ্দেশ্য ছিল চলতি পথে কোথাও যদি একটা চাকরী টাকরী হয়ে যায় । জ্ঞজীবনঞ্চ বাড়ী ফেরার দুদিন পর এ ঘটনার জন্য সকাল সাতটার দিকে তার বড় ফুফা অর্থাৎ মিজানের বাবা ও তার ছোট ফুফা অর্থাৎ মিজানের ছোট চাচা এক সাথে মটর সাইকেলে এসে জ্ঞজীবনঞ্চকে তাদের বাড়ীতে ডেকে নিয়ে যায় এবং সে এই সার্টিফিকেট চুরির সাথে জড়িত আছে বলে তাকে হুমকি দিতে থাকে । সে তাদের বুঝাতে চেয়েছে তার সার্টিফিকেট সহ হারিয়েছে । সে এ বিষয়ে কোন ঞ্চান রাখে না এবং আনিস ও সে সর্বক্ষণ একসাথে ছিল । মিজান ও আনিস তার আপন ফুফাতো ভাই সুতরাং সে তাদের এতবড় ক্ষতি কেন করবে ? তারা বলেছিল সে নেপথ্যে থেকে একাজ করিয়েছে । তার ছোট ফুফা অর্থাৎ মিজানের ছোট চাচার নতুন প্রেমে জ্ঞজীবনঞ্চ বাধা দিয়ে যাচ্ছিল তাই সে বুঝতে পারে তার ছোট ফুফা এখানে তাকে দিয়ে আরেকটা প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে । ওর বড় ফুফা এবং ছোট ফুফা একই বাবার ঔরসজাত কিন্ত সৎ ভাই । ওর বড় ফুফা হাইসকুলের ইংরেজী শিক্ষক । স্কুলের সময় হয়েছে তাই উনি দেরী না করে স্কুলে চলে যায় । ওর ছোট ফুফা অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ওকে জানিয়ে দেয়, সে যেন আর কখনো এদের সাথে না মেশে এবং আর কখনো যেন সে এ বাড়ীতে না আসে । অবশ্যই ওর বড় ফুফু সাথে সাথে তার একথার প্রতিবাদ করেছিল । বলেছিল তুই তার সামনে তার ভাইপোকে এতবড় কথা বলতে পারলি ? তার উত্তর ছিল, ভাবী তুমি বোঝ না তাই চুপ করে থাকো । সোজা আংগুলে ঘি উঠে না । একে টাইট দিলে সার্টিফিকেট বের হবে । তার ছোট ফুফা তাকে আরও জানিয়ে দেয় তার ছেলে হলে তাকে বলে যাবে, যেন সে কখনো তার সাথে না মেশে । জ্ঞজীবনঞ্চ বলে ছিল যদি আনিস ও মিজান বলতে পারে এই চুরির সাথে সে জড়িত আছে তাহলে সে এখানে বসেই সার্ঢিফিকেট পয়দা করে দেবে । এত আত্ম বিশ্বাস নিয়ে বলার পরও সেদিন আনিস ও মিজান তার বাবা চাচাকে সাহস করে বলতে পারেনি যে, না, সে এর মধ্যে জড়িত ছিল না । তাদের ব্যবহারে সেদিন সে আরও বেশী কষ্ট পেয়েছিল । চুরির বোঝা মাথায় নিয়ে সে কাঁদতে কাঁদতে তাদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসে । তার ফুফু অবশ্য কাঁদতে কাঁদতে ওর পিছনে এসেছিল কিন্ত সে আর পিছন ফিরে তাকায়নি । জ্ঞজীবনঞ্চ সকালে না খেয়ে গিয়েছিল । সে ক্ষুদার্তও ছিল । সে মনে মনে পরিকল্পনা করেছিল ফুফুদের বাড়ী হতে খেয়ে আসবে । সে রাস্তায় এসে কাঁদতে কাঁদতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিল হায় আল্লাহ, তুমি এর বিচার করো । এই এতিমের কষ্ট তুমি কবুল করো । কখনো তাকে ছেলে সন্তান দিও না । তার ছোট ফুফা তার প্রতি এতটা নির্দয় হবার কারণ ছিল ঐ একটাই । তার ছোট ফুফা তখন তার আগের প্রেমে পাগল হয়ে গেছে । যে করে হোক অর্থাৎ সে তার খালা গুল নাহারকে বিয়ে করবেই । জ্ঞজীবনঞ্চ তার ছোট ফুফুকে ভীষন ভালবাসে তাই তার ফুফুর দিকে তাকিয়ে সে চরমভাবে এই বিয়ের বিরোধিতা করে । বিয়ে ঠেকানোর জন্য সে প্রমান হিসেবে তার খালার প্রেমিকের সাথে উঠানো ছবি এনে তার ফুফুকে দেয়। ঐ ছবি কেন তার ফুফুকে দেখাল সেই জন্য সে সমাজের কাছে আরও ফাজিল হয়ে যায় । আর এ কারনে সার্টিফিকেট চুরির ঘটনা তার উপর চাপানো হয় । অবশ্য এক/দেড় মাস পর মিজানের হারিয়ে যাওয়া ঐ কাগজপত্র এবং সকল সার্টিফিকেট খুলনা সিটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের টেবিলের উপর কে বা কারা রেখে আসে । জ্ঞজীবনঞ্চ শত চেষ্টা করেও সে তার ছোট ফুফার দ্বিতীয় বিয়ে ঠেকাতে পারেনি । অনেক বছর পর জ্ঞজীবনঞ্চএর ছোট ফুফু তাকে বলেছিল তার দু মেয়ে আবার তার খালারও একটি মেয়ে এর পর যদি তাদের ঘরে কোন ছেলে সন্তান না হয় তাহলে সত্যিই তাদের দুঃখ থেকে যাবে । জ্ঞজীবনঞ্চ তার ফুফু মালিহাকে প্রশ্ন করেছিল তার খালার ছেলে সন্তান হোক সেটা কি সে চায় ? ওর ফুফু ওকে বলেছিল তুই অতীত ভূলে যা, তোর ফুফা এখন আমার সাথে ভাল ব্যবহার করে । তুই আর মনে কষ্ট রাখিস না । ওর ফুফুর বিয়ের তিন চার বছরের মাথায় আবার দ্বিতীয় বিয়ে করে । সুখ কি জিনিস সে পায়নি । সারাটি জীবন লাঞ্চনা গঞ্জনার ভিতর কেটেছে তার । যার কখনো চোখের পানি শুকায়নি । সারাজীবন অসহ্য যন্ত্রনায় কেঁদে কেঁদে যে রাত পার করেছে, সে আজ তারই জন্য সুপারিশ করছে । জ্ঞজীবনঞ্চ তার ফুফুর ব্যবহারে অবাক হয়ে যায় । ভাবে হয়ত এ ধৈর্য্য পরীক্ষা দিয়ে সে আজ সফল হয়েছে । সবাইকে আবার আপন করে নিয়েছে । ফিরে পেয়েছে জীবনের একান্ত আপনজনকে । তার ফুফুর কথামতো জ্ঞজীবনঞ্চ অনেক বার নামাজের মধ্যে মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে কেঁদে বলেছে হায় আল্লাহ তুমি তাকে মাফ করে দাও । তার প্রতি আজ আর কোন দুঃখ নেই । সে সকলকে ক্ষমা করে দিয়েছে তাই তুমিও তোমার বান্দাকে ক্ষমা করো । তার মনের বাসনা পুর্ন করো । এবার তাকে একটি ছেলে সন্তান দাও । তার খালার গর্ভে ছেলে সন্তান হওয়ার সংবাদে জ্ঞজীবনঞ্চ ভীষন খুশী হয় । তাই বলে জ্ঞজীবনঞ্চ এমনটি কখনো ভাবে না যে, তারই দোয়ায় হয়েছে । এ সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা । তার মনের সান্তনা এই যে, সে তাকে ক্ষমা করতে পেরেছে এবং তার ছেলে সন্তানে তাদের মত সেও অনেক খুশী হয়েছে ।


বিশ

বাবা হারানোর বেদনার রেশ কাটতে না কাটতেই জ্ঞজীবনঞ্চ এর পরীক্ষা এসে যায় । পরীক্ষা শেষ করে সে জড়িয়ে পড়ে ক্লাব আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে । তার হাতে এখন প্রচুর সময়। তার আপনজনেরা তার বিরুদ্ধে আগের চেয়ে এখন বেশী সোচ্চার হয়ে উঠেছে । কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছাডাও আপনজনদের স্বার্র্থের ব্যাঘাত ঘটে এমন কাজের প্রতিবাদও সে করে । তার একটাই কথা, ন্যায় অন্যায়ের বিচারে কে আপন আর কে পর তা দেখলে সঠিক বিচার করা যায় না । আত্মীয় বলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যায় না । তার কাছে সবাই সমান, সবাই আপন । কে হিন্দু, কে মুসলমান আর কে আত্মীয় তা সে বোঝে না, বুঝতেও চায় না । সে বোঝে ভাল কাজের জন্য সবাই আপন। বরং শোষিতের পক্ষে লড়াইয়ে তার আজম্মের সাধনা । একবার এলাকার কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি তাদের লোকজন নিয়ে ভোট কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট এরশাদের মনোনীত ব্যক্তির জন্য প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক ব্যালট পেপার নিয়ে ইচ্ছেমত ভোট দিতে থাকে । জ্ঞজীবনঞ্চ কেন্দ্রে ঢুকে এ দৃশ্য দেখে তার মাথা ঘুরে যায় । সমাজের সমাজপতি, শিক্ষিত লোক, এরা যদি অযোগ্য একটি লোকের জন্য এভাবে ভোট ছিনতায় করে তাহলে দেশটা কোথায় যেয়ে দাড়াবে । সে আর পিছন ফিরে দেখে না । ছুটে চলে যায় ক্লাবের সভাপতিসহ বেশ কয়েকজনের কাছে । অল্প সময়ের মধ্যে সে তাদেরকে বুঝাতে সমর্থ হয় । এর পর তারা একত্রে দশ বারোজন ফিরে আসে কেন্দ্রে । ক্লাবের সেক্রেটৗরী জাহাংগীর কেন্দ্রে ঢুকে তাদের কাছ থেকে সীল ও ব্যালট পেপার কেড়ে নেয় । তারপর তাদের এলাকার একজন প্রার্থীর (নাম কেরামত আলী ) প্রতীকে সীল মারতে থাকে । তাদের এ দৃশ্য দেখে তারা বুঝতে পারে ঘটনা কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে । এ কেন্দ্র হতে এরশাদের মনোনীত প্রার্থী না জিতলে তাদের সম্ম্‌ানের ব্যাপার তাই তারা তাদের সাথে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। তাদের পক্ষ থেকে জাহাংগীর ও হারুনকে বলা হয় ক্লাবের সব ইচ্ছা পুরন করা হবে তবে শর্ত একটা আলোচনায় জ্ঞজীবনঞ্চ থাকতে পারবে না । ক্লাবের সবার এক কথা, সবাই না থাকলে সে আলোচনায় তারা কেউ বসবে না । ওরা চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে আসে । পরে চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে বিভিন্ন প্রলোভন দেখায় ক্লাবের সদস্যদের । জ্ঞজীবনঞ্চ সে প্রস্তাব শুভংকরের ফাকি বলে মেনে নেয় না । চেয়ারম্যান বলেছিল এই বয়সে তোমরা জাহাজের গায়ে ডিংগি নৌকা বাধার সাহস পাও কিভাবে ? প্রতিউত্তরে রশিদ বলেছিল বাধতে না পারলেও গুতা মারতে তো পারবো । এই কথাটি তারা চেয়ারম্যানকে অন্য ভাবে বুঝিয়ে বলেছিল আপনাকে মারার পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে গেল। চেয়ারম্যান না বুঝে তার লোকদের আদেশ দিল ওদেরকে যেখানে পাবে সেখানে মারবে । চেয়ারম্যানের এমন নির্দেশে চেয়ারম্যানের ফুফাতো ভাই হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এর কাছে সবাইকে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয় জ্ঞজীবনঞ্চ । সবাই উনার কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বলে আসে । কেননা জ্ঞজীবনঞ্চ বাদে বাকীরা সবাই তারই ছাত্র । তাই তাদের বিশ্বাস ছিল স্যারকে বললে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে । অবশ্য উনার কথামতো চেয়ারম্যান পরে তার আদেশ উঠিয়ে নেয় । এসব বিভিন্ন কারনে তারা জ্ঞজীবনঞ্চকে টার্গেট করে । একবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষে দুইদিন পর তার উপর বোমা মারা হয় । অবশ্য ঐ ঘটনা ভিলেজ পলিটিক্সের পুর্বের কোন ঘটনার জের ধরে নয় । অন্য একটি গ্রুপ এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চেয়েছিল । যাদেরকে সে অনেক আগে একটি চুরি কেইসে অপমানিত করেছিল । তারা তাকে প্রকাশ্যে কয়েকবার মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছিল । কিন্ত সে কখনো ঐ হুমকি আমলে নেয়নি । এ অবন্থায় তার মা তাকে পড়াশুনা না করে বাড়ী ছেড়ে কোন চাকরীতে ভর্তি হওয়ার প্রস্তাব দেয় ।







একুশ

জ্ঞজীবনঞ্চ তেজদীপ্ত, চঞ্চলতায় সাহসী এক তরুন । যুদ্ধে যাবার যন্ত্রনায় রক্ত টগবগ করছে । দেশ মাতৃকার সেবায় মন উদ্বেলিত । যেখানে সে জন্মগ্রহন করেছে, যে মাটিতে সে তিল তিল করে বেড়ে উঠেছে । বর্ষাকালে দুরন্তপনায় যে নদীতে লাফিয়ে সাঁতার কেটেছে । যে তার জন্মভুমিকে ভালবেসেছিল এক রহস্যময়ী নারীর মত, ভালবেসেছিল তার মায়ের মত, ভালবেসেছিল তার ছোট বোনের নরম তুলতুলে সেনহে । যে গ্র্রামে তার শৈশব, কৈশর কেটেছে এক উষ্ণ নিবিড় সান্নিধ্যে । তার স্পর্শে সে জেগেছে আবার ঘুমিয়েছে । বাইরের পৃথিবী সে চেনে না এবং জানেও না । তার পৃথিবী শুধু তার জন্মস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ । সে হয়ত একদিন তার এই ছোট্র পৃথিবীতে থাকবে না, কিন্ত এই মুর্হতে সে যে মহারাজপুর গ্রামের গন্ধ উপভোগ করছে । সত্যি বড় ভাল লেগেছিল তার এই গ্রামের সেনহ, তার ছোট্র পৃথিবীর ভালবাসা । বাঁচতে ইচ্ছে করে তার এই সাধারণ মানুষের পাশে থেকে, কিন্ত সে নিশ্চিত জানে, যে স্মৃতির শেকড় ধরে সে মানুষের সেবায় দাড়াতে চায়, তা কোনদিন হবার নয় । কেননা সে স্বচক্ষে দেখে উপলব্ধি করেছে, ব্যক্তি স্বার্থের উর্দ্ধে বেরিয়ে আসতে পারে না অনেকে । একশত টাকার কচকচে নোটের মধ্যে ব্যক্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে । তাই আর যাইহোক এই ভদ্র সমাজে তার মত অভাবী লোকের স্থান নেই । কেউ তাকে মুল্যায়নও করবে না, তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে চায় এই সমাজ । বার বার তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়েছে । এবার তার ফিরে যাবার পালা । মনের কিছুটা সান্তনা দেয় এভাবে যে, এখানে হয়ত কিছুটা দেশ সেবার সুযোগ পাবে, তাই সে অদম্য স্পৃহা নিয়ে যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে । সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সে তার প্রফেশনাল কাজে দক্ষতা অর্জনে মনোনিবেশ করে । পিতৃহীন সংসারের দায়িত্ব তার উপর পড়ে । ভালই চলছিল তার । ভুলে যেতে চায় সব অতীত স্মৃতি । হঠাৎ দু বছর পর লাইলীর চিঠির মধ্যে নাজ এর লেখা দু লাইনের একটা চিঠি পায় সে । নাজ এর চিঠি পেয়ে সে পুর্নিমার চাঁদ হাতে পায় । ফিরে পায় মৃত আত্মায় সজীবতা । সে আনন্দে পাখনা মেলে, ঝোটন তুলে বাকবাকুম করে উঠে । নাজ লিখেছিল,

জ্ঞজ্ঞআমার ভূল বুঝতে পেরেছি, আমি আর পারছি না । তুমি ছুটি নিয়ে বাড়ী এসো, তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছেঞ্চঞ্চ।

ইতি

তোমারই নাজ



জ্ঞজীবনঞ্চ তার চিঠি মোতাবেক বাড়ী এসেছিল । তাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে সন্ধ্যেবেলা যাবার সময় ওদের দঞ্চুবোনের সাথে দেখা হয়ে যায় । সে নাজকে বলেছিল তার চিঠি পেয়ে সে এসেছে । নাজ আনন্দে গদ গদ হয়ে তাকে অভিনন্দন জানায় । শার্টের পিছন দিকে টেনে ধরে বলেছিল, সত্যিই বলছ ? হ্যা, সে সত্যিই বলছে, তাঞ্চনাহলে সে এত তাড়াতাড়ি কি করে আসলো ? পুচকি টা খুবই দুষ্ট । সে বলল, এত দরদ থাকলে চকলেট কোথায় ? ওর আবার ইগলু আইসক্রীমের উপর ভীষন লোভ । ওর লোভ এর ব্যাপারটা জ্ঞজীবনঞ্চ জানে বলে বলেছিল, চকলেট কেন ? চকলেট নয়তো আইসক্রীম দেবে কোথেকে ? ভারী পাকা পাকা কথা শিখেছ তাই না ? ওর উত্তর, এখন আর ছোট নই, নাইনে পড়ি । বড় ডাগর হয়েছ যে,এটা দেখেই বুঝতে পারছি জানায় জ্ঞজীবনঞ্চ । এসব কথা বলতে বলতে ওরা দুঞ্চবোন জ্ঞজীবনঞ্চ কে ওদের বাড়ীর সামনের ব্রিজ পর্যন্ত যায় । সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, পরেরদিন দেখা হবে জানিয়ে সে তাদেরকে বাড়ী যেতে বলে সে নিজেও দ্রুত পায়ে চলে আসে । অবশ্য গোপনে ঐ পুচকীর হাতে সে চারটি কোকো চকলেট গুজে দিয়েছিল । পরেরদিন সে নাজকে সাথে করে কলেজে গেলেও, নাজ কলেজে না গিয়ে ওর সাথে উপজেলায় ঘুরেছে । রেষ্টুরেন্টে বসে নাস্তা করার সময় নাজ বলেছিল বাবা মা রাজী না হলেও সে তার কাছে চলে আসবে । কোট ম্যারেজের প্রস্তাবও উঠে । অবশ্য সফি ওদের সাথে ছিল । ওদের মাঝে আরও অনেক কথা হয় । ঐ তারিখে বিয়ের প্রস্তুতিও হয় । রাতে সে অনেক ভাবে । সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার সারা জীবনের আত্ম বিশ্ব্‌াসকে বিসর্জন দেবে না । জ্ঞজীবনঞ্চ বিশ্বাসের ঘরে আগুন দিতে চায় না । সে সবার মন জয় করে এ কাজ সমাধা করতে চায় । তাই জ্ঞজীবনঞ্চ এর ফুফাতো ভাই মাওলানা মিজানকে দিয়ে নাজ এর বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠায় । নাজ এর বাবা মাওলানা মিজানকে জানিয়েছিল, যেহেতু এটা পারিবারিক সিদ্ধান্ত তাই উনি চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ না করে কিছু জানাতে পারবেন না । পরেরদিন সন্ধ্যায় নাজদের বাড়ীতে সফি গিয়েছিল তাদের পরবর্তী দিনের প্রগ্রাম জানাতে । নাজ এর দাদী সফিকে বলেছিল এই সন্ধ্যায় কি জন্য এসেছিস ? সফি রসিকতা করে বলেছিল নাজকে বিয়ে করার জন্য । এ প্রেক্ষিতে তার দাদী সফিকে কি বলেছিল সে কথা সে জ্ঞজীবনঞ্চকে না জানিয়ে সফি শুধু জ্ঞজীবনঞ্চ কে হাত জোড় করে বলেছিল তুই নাজকে বিয়ে করার ভূততা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে । আর কোনদিন নাজ এর জীবনে আশিস না । হঠাৎ তার এ মন্তব্যের কারণ জিঞ্চাসা করলে সে বলেছিল এখন বলতে পারবো না, তবে তোর বাবা নেই, তোর মাকে তুই কষ্ট দিস না । জ্ঞজীবনঞ্চ বলেছিল তাহলে তার নাজ এর কি হবে ? সে কি নিয়ে বাঁচবে । তার এমন হয় কেন ? সে এমন কি পাপ করেছে, যে গাছ টা ধরে সেটাই ভেংগে যায় । সফি কথা না বাড়িয়ে বলে, তোর কোন্‌ শিক্ষক তোকে চিঠি দিয়েছে তুই তাদের সাথে যোগাযোগ কর । জ্ঞজীবনঞ্চ বাড়ীতে এসে তার দাদীকে দুষ্টমী করে বলেছিল রাঙা বউ দেখতে চাও নাকি ? দাদীও কম যাবার নয়, বলল, তোমার মুরদে না । জ্ঞজীবনঞ্চ তার বড় ফুফুকে ঐ শিক্ষকের চিঠি দেয়ার ব্যাপারটা বলেছিল । ওর ফুফু দেরী না করে সাথে সাথে ওর দাদাকে বলে দেয় । ওর দাদা ওকে কাছে ডেকে বলেছিল ওদের ফ্যামিলি ভাল, ওরা যদি তোমাকে মেয়ে দিতে চায় তবে তাদেরকে আমার সাথে কথা বলতে বলো । ওর দাদা আবেগ দিয়ে বলেছিল আমিতো মনে করেছিলাম তোমরা এখন বড় চাকুরী কর, হয়ত আমার কথা রাখবে না, তাই সাহস পাই না । তোমার বউকে দেখে যাবার খুব সখ আমার । জ্ঞজীবনঞ্চ নাজ এর কথা ভাবতে থাকে। সে সুযোগ বুঝে ওর দাদাকে বলেছিল হেড মাষ্টারের মেয়ে নিলে হয় না ? ওর দাদা রেগে যায়, দাদার সামনে দ্বিতীয় বার কথা বলার শক্তি ওদের কারোর নেই । শিক্ষকের শ্যালীকা দেবে ওর দাদা জেনে গেছে তাই ওর আর রক্ষা নেই । সকালে উঠেই শুরু হয়ে গেল তাদেরকে সংবাদ দেয়া হয়েছে কিনা ? দাদার পিড়াপিড়িতে তাদের মন রক্ষা করার জন্য জ্ঞজীবনঞ্চ সেখানে যায় । নাজ এর কথা ভেবে পাশ কাটিয়ে আসার চেষ্টা করে, কিন্ত আবার সফির সেই না জানা কথাগুলো মনে পড়ে । এক পর্যায় নাজকে মাঝ নদীতে ভাসিয়ে তার দাদার শেষ ইচ্ছের কাছে এবং সকল শিক্ষকদের আবেদনে সে সেখানে বিয়ে করতে রাজী হয় । অনেকদিন পর নাজ এর বড় ভাই সুযোগ বুঝে তাকে বলেছিল তোকে আমার কাছে আসার কথাছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ বুঝতে পারে অনেক পুরাতন সেই কথা । তাই সে ইচ্ছে করে এড়িয়ে গিয়ে বলেছিল তোর বোনের যোগ্যতা সে আজও অর্জন করতে পারেনি তাই তার আর আসা হয়নি ।




বাইশ

কর্মজীবনে এসে জ্ঞজীবনঞ্চ তার সব কিছু ফিরে পায় । যে তাজ, তার প্রেম শিখাবে বলে হুমকি দিয়েছিল সেই তাজ এর সাথে তার অনেক বছর পর দেখা হয় । তাজ তাকে দেখে আবেগপ্লুত হয়ে চোখ দুটো স্যাতসেতে করে নাক মুছতে মুছতে তাকে বলেছিল, সে সারাটা জীবন তারই আছে । সামান্য অভিমানের জন্য তার জীবনটা বৃথা হয়ে গেল । প্রেম করেছিলে কিন্তু তোমার তাজ এর অভিমানটা কখনো বুঝার চেষ্টা করোনি । শুধু কাঁদিয়ে কষ্ট দিয়ে গেলে । অনেক বছর পর জ্ঞজীবনঞ্চকে একান্তে কাছে পেয়ে সে বলেছিল কোনদিন একটি বারের জন্য জানতে চাওনি তোমার তাজ কেমন আছে ? অথচ এই সেই তাজ আজও সারাটি জীবন তোমার প্রতীক্ষায় আছে । ভালবাসতে জানো না বলেই সেদিন অভিমানটা বুঝতে পারনি । প্রথমদিন তার প্রেম ফেরত দেয়াছিল একান্ত্ত অভিমানের । তাজ বলেছিল প্রেম একান্ত দুজনার । সেখানে খালেদা, আমিনুর ও রশীদ জানবে কেন ? তোমার উপর ভীষন রাগে আমি অভিমান করে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি । কিন্ত তুমি এতটাই বোকা যে, প্রিয়জনের অভিমানটা বুঝতে পারলে না । মনের জোরে আমাকে ধরে কেন বললে না যে, তাজ তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না । আমার এক অভিমানের ভয়ে কাপুরুষের মত দুরে সরে গেলে ? অথচ তোমার এই তাজ সারাটি জীবন তুষের আগুনের মত ধুকে ধুকে মরছে । আমি শুধু তোমার কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম যে, তুমি বলবে তাজ, তোমাকে আমি ভালবাসি । আমার নারী জীবন সার্থক হবে । তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে কি সুখ পেয়েছ ? ভালবাসা কাকে বলে তা বুঝে উঠার আগেই যাকে প্রেম নিবেদন করেছ, সে কি কখনো অন্য পুরুষকে ভাবতে পারে ? জ্ঞজীবনঞ্চ ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠে । তাজ এর মনের ভিতর এতদিনের জমে থাকা কষ্টের কথাগুলো জ্ঞজীবনঞ্চ নিরবে শুনছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ ফিরে যায় সে সময়কার তার ফেলে আসা দিনগুলির ডাইরীতে । তাজ এর ভালবাসার অভাবে কি কষ্টে তার সেই দিনগুলি কেটেছে । তার চোখ ছল ছল করে ভিজে যায় । দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মনে হচ্ছিল এই মুর্হুতে তাজকে জড়িয়ে ধরে বলবে তাজ তুমি শুধু আমারই তাজ । তুমি অন্য কারোর হতে পারো না । আমার জন্য বিধাতা তোমাকে সৃষ্টি করেছে । তুমি আমার বাহুডোরে চিরদিন থাকবে । কিন্ত তা আর হয় না । জ্ঞজীবনঞ্চ অনাধিকার চর্চা করতে চায় না । তাজ এখন অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী । তাকে স্পর্শ করার অধিকার তার নেই । সে নিজেকে সংযত রেখে এতটুকু আনন্দ পায় যে, তার ভালবাসা ব্যর্থ হয়নি । তার চাওয়া পাওয়া যে সত্য ছিল তা আজ বাস্তবে সে জানতে পেরেছে । তারপরও নিজেকে বড় অপরাধী ভাবছে । সে তাজকে মানষিকভাবে কষ্ট দিয়েছে অথচ সে সব সময় তাকে সুখী দেখতে চেয়েছে । তার সুখেই সে সুখী । কেননা তার ভালবাসার মানুষটি কষ্ট পেলে তারও কষ্ট হবে । অথচ জ্ঞজীবনঞ্চ এর জন্য সে আজও কষ্ট পাচ্ছে । এতটি বছর আজও তাকে স্মরণ রেখেছে । তাকে সে ভুলতে পারেনি । এত বছর পর, দেখা হওয়ার পরও অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে জ্ঞজীবনঞ্চ তার কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নেয় কেননা তার চট্রগ্রামের গাড়ী ধরতে হবে। হাতে সময় একেবারে কম । বিদায় বেলায় তাজের দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিল । জ্ঞজীবনঞ্চ নিজকে সামলিয়ে নিয়ে তাকে বলেছিল, তুমি কাঁদছ কেন ? তাজ বলল, এ কষ্টের কান্না নয়, অনেকদিন পর তোমাকে কাছে পেয়ে বরণ করে নেয়ার কান্না, এ আনন্দের অশ্রুধারা । এ পানি দিয়ে তোমাকে আটকিয়ে রাখব না। সে অধিকারও আজ আর আমার নেই । বিদায় বেলায় তাকে বলেছিল শুধু জেনে রেখ তোমার তাজ যেখানে থাকুক না কেন সব সময় তোমারই কাছেই আছে । জ্ঞজীবনঞ্চ তার ভালবাসাকে ফিরে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর মাথার উপর থেকে সরে গেছে শনির দশা তাই সে ফিরে পায় নাজেরও আকুল আবেদন । পায় তার পিতা মাতারও ভালবাসা । যারা একদিন তাকে দেখে নাক ছিটকাতো, সে আজ তাদের কাছে চরিত্রবান, ভদ্র ছেলে বলে পরিচিতিও পেয়েছে । তাকে ডেকে আদর করে তার মা বলেছে যে, ছোট মেয়েটা তোমার হাতে তুলে দিলাম । তাকে বিয়ের সব ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে । জ্ঞজীবনঞ্চ ভাবে একদিন যে কুমীরের ভয়ে তার মা, মেয়ে দুটোকে আচলের মধ্যে লুকিয়ে রাখতো, আজ সেই মা, কুমীরের হাতে মেয়ে সর্মপন করছে । জ্ঞজীবনঞ্চ তার গায়ে চিমটি কেটে দেখে সে স্বপ্ন দেখছে নাতো ? না সবই ঠিক আছে । জ্ঞজীবনঞ্চ কখনো তার বিশ্বাসের ঘরে আগুন দেয়নি । আজও না দেবার প্রত্যয় । তার মা বাবার মন জয় করতে পেরেছে । তাকে পাত্রস্থ করার জন্য সে তার আপ্রান চেষ্টা করেছিল । অবশ্য তখন নাজ এর বিয়ে হয়নি । তার বিয়ে হয়েছে অনেক পরে । তার সাথে জ্ঞজীবনঞ্চ এর অনেকবার দেখা হয়েছে ওর ভাইয়ের ঢাকায় ভাড়া করা বাসায় । ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জ্ঞজীবনঞ্চ নিজকে অপরাধী ভেবে সংকোচ বোধ করত । সে শুধু ভাবতো তার দাদী এমন কি বলেছে যে, তাদের দুটি জীবন এভাবে দুদিকে বয়ে গেছে । কিন্ত জ্ঞজীবনঞ্চ তার দাদীর সেই কথা কোনদিন তাদেরকে জানতে দেয়নি । বাইরে সবার সাথে মিলে মিশে থাকলেও সে নাজের জন্য কষ্ট অনুভব করে । ভাবে মানুষের জীবন এত বৈচিত্রময় কেন ? ভাবনার কোল ছাড়িয়ে সে ব্যর্থ জীবনে কিছুই পায় না ।



তেইশ

তাজ এবং নাজের কথাগুলি জ্ঞজীবনঞ্চএর মনে রেখাপাত করলেও সে কখনো তার স্ত্রীকে বুঝতে দেয়নি । শয়নে স্বপনে নিদ্রায় জাগরণে তাদের কথা স্মরণ হলেও জ্ঞজীবনঞ্চ কখনো তার স্ত্রীকে ঠকায়নি । হ্নদয়ের সব ভালবাসা উজাড় করে তাকে কাছে টেনে নিয়েছে । তার জীবনের অপূর্নতাগুলি তারই মাঝে পুর্নতা পেয়েছে । আর তার স্ত্রীও তাকে সেভাবে ভালবেসেছে । কেননা সে বিয়ের আগে যখন তার স্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিল তখন তাকে তার জীবনের কিছু অজানা কথা তাকে জানিয়েছিল । বলেছিল, দাম্পত্য জীবনে সে সুখী হতে চায় । পিছনের কোন জিনিস টেনে এনে নিজেদের সুখ শান্তি বিনাশ করা যাবে না । খোলাখুলি কথা বলাতে হয়ত তার স্ত্রীও সেদিন খুশী হয়েছিল । তারপরও তার স্ত্রী তাকে কতটা ভালবাসতে পেরেছে তার গভীরতা সে কোনদিন মাপেনি । তার স্ত্রীর সকল সহযোগিতায় এবং কর্মকান্ডে নিজেকে মনে করে, সে বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রীকে নিয়ে ভীষন সুখী ।

জ্ঞজীবনঞ্চকে একদিন তার যে বড় ফূফা বাড়ীতে ডেকে নিয়ে সার্ঢিফিকেট চুরির দায়, মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাদের বাড়ী থেকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তাদের বাড়ীতে চির জনমের জন্য যেতে নিষেধ করেছিল, সেই ফুফার চার মেয়ের মধ্যে তিন মেয়েকে বিয়ে দিতে তারই প্রয়োজন হয়েছিল । তারই একান্ত প্রচেষ্টায় বিয়েগুলি সম্পন্ন হয় এবং তার মেজ ছেলে মিজানের বিয়েতে ঢাকাতে লোকজনের থাকা খাওয়ার ব্যবন্থা তার বাসায় করেছিল । অবশ্য এজন্য সে অহংকার বা গর্ববোধ করে না । শুধুু আল্লাহকে স্ম্‌রণ করে । সব কিছুর নিয়ন্তা একমাত্র আল্লাহ । সকল প্রশংসা ও কৃতঞ্চতা একমাত্র আল্লাহর জন্য । শুধু তাই নয় । তার ঐ ফুফা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকাতে তার বাসায় একধারে সাত/আট মাস থেকে চিকিৎসা করায় । তার ফুফু বলেছিল তোর বাসায় আসতে আমি লজ্জাবোধ করছিলাম । তোর কাছে আমাদের আসার মুখ নেই তবুও আসতে বাধ্য হয়েছি । সে তার ফুফুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল ,ছি ছি, ফুফু তুমি কি বলছ ? এটা আমার কর্তব্য । মিজান দেশে থাকলে যা করত আমি তার চেয়ে কম করব না । আমার উপর আস্থা রাখো । এখানে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না । জ্ঞজীবনঞ্চ এর ন্ত্রী পারভীন তার বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আবার তার ফুফাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে বেরিয়ে যেত । কেননা জ্ঞজীবনঞ্চ এর কড়া আদেশ তার ফুফু যেন কোন সময় বাসার বাইরে না যায় কেননা প্রথম ঢাকায় এসেছে, ঢাকার কোন কিছু চেনে না, শেষে হারিয়ে যাবে সেই ভয়ে । তাই পারভীন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে কোন এুটি করেনি । তার ফুফাকে সেবা শ্রুষা করায় এবং সময়মত দেখাশুনা করায় জ্ঞজীবনঞ্চ তার স্ত্রীর প্রতি ভীষন খুশী । কেননা, জ্ঞজীবনঞ্চ কাউকে কোন কিছু দিয়ে আনন্দ পায় । বিলিয়ে দিতে চায় তার ব্যক্তি জীবনটা । সারা জীবন হোচট খেয়েছে সুতরাং এখন তার বিলিয়ে দেয়ার সময় এসেছে । ডাক্তার দেখানোর জন্য কোনদিন না খেয়ে সারাদিন ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরত তার স্ত্রী । তার চাকুরীর জবাবে সে নিজেকে বেশী সময় দিতে পারতো না । তাই ওর স্ত্রীকে দেখাশুনা করতে হতো । ওর স্ত্রীর ব্যবহারে ওর ফূফা বলতো, তুমি আমার সত্যিকারের মা । ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি । মায়ের আদর,যত্ম কি তা পাইনি । তুমি যেন আমার সেই মা । ওর ফূফা বলতো জীবনে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে সব কিছু পেয়েও আজ মনে হচ্ছে তোমার আদর ছাড়া জীবনে আমি আর কিছুই পাইনি । সব থাকতে আজ আমার কিছুই নেই । এমন বিপদের দিনে ছেলে মেয়েরা কেউ কাছে নেই । তোমার এই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না । এমনকি আমার সকল সম্পত্তি যদি তোমাকে লিখে দেই তাও এ শোধ হবার নয় । বর্তমান যুগে এরকম উপকার কয়জনে করে ? মাসের পর মাস ঢাকার মত জায়গায় তোমাদের ভাড়া করা বাসাতে আছি । জ্ঞজীবনঞ্চ সে তো বেতনও বেশী পায় না । তাছাড়া আমাকে দেখতে আসা আমার মেহমানদের ঝামেলাও সইতে হচ্ছে । তোমাদের উপর আমরা একটা বাড়তি বোঝা হয়ে গেলাম । জ্ঞজীবনঞ্চ বলতো এসবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা । এখানে তার কিছুই করার নেই । যার যেখানে রিজিক আছে সে সেখানে যেভাবেই হোক না কেন চলে যাবেই । ঈমানদার হিসেবে এই বিশ্বাস টুকু অবশ্যই করতে হবে । জ্ঞজীবনঞ্চ এর সেই ফুফা আজ আর বেঁচে নেই । তার জীবনের শেষ মুর্হুতগুলি তার কাছে কেটেছে তাই তার ফুফার জন্য ভীষন কষ্ট অনুভব করে । মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে দোয়া করে যেন তিনি জান্নাতবাসী হয় । জ্ঞজীবনঞ্চ এর যে ছোট ফুফা আবেদ সাহেব তার পদে পদে আঘাত,অপমানিত, অপদস্থ করেছে সেই ছোট ফুফাকে বিভিন্ন সময় তার সাধ্যের মধ্যে উপকার করার জন্য পাশে দাড়িয়েছে । একবার হাইস্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় স্কুলের নাইন/টেনের কিছু উদ্ভট ছেলে তাকে মারার জন্য বাজারের মধ্যে আটকে ফেলে । তখন জ্ঞজীবনঞ্চ এর সাথে তার ফুফা (আবেদ সাহেব) এর চরম বিরোধ চলছে । কিন্ত যখন সে জানলো যে, আবেদ সাহেবকে বাজারের ভিতর অপমান করা হচ্ছে তখন সে, সেখানে গিয়ে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে । তার উপস্থিতিতে আবেদ সাহেবকে অপমান করা হচ্ছে এটা সে মেনে নিতে পারেনি এবং যে জন্য অপমান করা হচ্ছে সেটা সম্পুর্ন ষড়যন্ত্র ছিল । তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রদেরকে উস্কে দিয়েছিল । ছাত্রদের সাথে সে নিজেই গোলযোগে জড়িয়ে পড়ে । তাতে তার কোন দুঃখ নেই, সে তার ফূফা আবেদ সাহেবকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে, তার এবং জ্ঞজীবনঞ্চ এর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় । মানুষ মানুষেরই জন্য । মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই । এছাড়া বিভিন্ন্ব সময় সে তার ফুফার পাশে এসে দাড়িয়েছে । সব ঘটনাগুলো নির্দিষ্ট করে বলাটা ঠিক হবে না । সেটা উপকারের প্রতিদান নেয়া হবে । নিজকে তার কাছে ছোট মনে হবে । তাই পাঠককে কিছুটা বুঝে নিতে হবে । এসব ঘটনার ঘনঘটা উল্লেখ করে সে তাদেরকে ছোট করতে চায়না । বরং সে তার জীবনে অনুভব করে, যারা একদিন দুর দুর করে তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সে আজ আল্লাহর অশেষ রহমতে তাদের জন্য কিছু করতে পেরেছে । শেষ রাতের স্বপ্ন যেমন কিছুটৗ সত্যের মত বাস্তবের সাথে মিলে যায় ঠিক তেমনি তার বাউন্ডেলে ৪২০ জীবনের একান্ত চাওয়া পাওয়া গুলোও সেই রকম দিবালোকের মত প্রস্ফুটিত হয়ে তার জীবনে উদ্ভাসিত হয় ।

Post a Comment

0 Comments